25/12/2021
কবুতর পালনে আমি যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর ও সমস্যার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবো। কোন ভুল থাকলে শুধরে দিবেন আশা করি।
প্রশ্নঃ১- কবুতর কিভাবে জোড়া দিবো?
প্রথমে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে কবুতর দুটি নর ও মাদি এবং বয়স ৬মাস+। নর-মাদি নিশ্চিত হওয়ার পর দুটোকে ৫ দিন আলাদা করে রাখবেন যেন এরা একে অপরকে দেখতে পায়। এ সময় নর মাদি উভয়কে ই ক্যাপ-২০০ ক্যাপসুল একটা করে একদিন পর পর খাইয়ে দিবেন। এরপর একসাথে করে দিবেন। সময় কম-বেশি লাগতে পারে।
প্রশ্নঃ ২- নতুন কবুতর পোষ মানাবো কিভাবে?
প্রথমে কবুতরের ৭ পর করে দুই পাখা টেপ বা সূতা দিয়ে আটকে দিবেন এবং খোপের মধ্যে এমন ভাবে রাখবেন যেন খোপের সামনের দিকটা দেখতে পায়। এভাবে ৭ দিন রাখার পর এক পাখা খুলে দিবেন। এসময় বাইরে বের হলে খেয়াল রাখবেন যেন কোনভাবে ভয় না পায় বা বন্য প্রানির আক্রমনের শিকার না হয়। এরপর ৩ দিন পর অন্য পাখাও ছেড়ে দিবেন। পুরো সময়টাতে ভালো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। জোড় হলে নরের পাখা আগে ছাড়বেন, নর পোষ নিলে তখন মাদির পাখা ছাড়বেন। সময় কম-বেশি লাগতে পারে।
প্রশ্নঃ৩- সবুজ পায়খানা হলে কি করবো?
সবুজ পায়খানা হলেই যে কবুতর অসুস্থ তা কিন্তু নয়। কবুতর নতুন পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে পড়লে, ডিম দিলে পায়খানা সবুজ বা পাতলা হতে পারে। সেক্ষেত্রে কবুতরের একটিভিটি বা পায়খানা দেখে অসুস্থ মনে হলে চিকিৎসা করতে হবে।
প্রশ্নঃ৪- কবুতরের ঠাণ্ডা লেগেছে কি করবো?
কবুতরের ঠাণ্ডা লাগলে, হাঁচি দিলে বা বুকে গরগর শব্দ হলে বাচ্চাদের(মানুষের) হিসটাসিন সিরাপ ০.৫ মিলি করে দুইবেলা খাওয়াবেন। প্রতিরোধ হিসাবে কবুতরকে মাঝে মাঝে আদা কুঁচি , লবঙ্গ খাওয়াতে পারেন।
প্রশ্নঃ৫- ক্রিমি কোর্স কিভাবে করাবো?
ক্রিমি কোর্স আবহাওয়া গরম থাকলে, ২-৭ দিনের বাচ্চা থাকলে, ২-৩ দিনের মধ্যে ডিম দিবে, খালি পেটে থাকলে এবং কবুতর অসুস্থ থাকলে না করানোই সর্বোউত্তম। ক্রিমি কোর্স করানোর আগে কবুতরকে ৩-৫ দিন লিভার টনিক দিতে হবে। লিটা ভিট/হেপাটনিক সিরাপ ১.৫মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে খাওয়াবেন। এরপর এভিনেক্স/এসিমেক পাউডার ১.২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে একবেলা খাওয়াবেন। কখনই একদিনে দুইবেলা বা দুইবার দিবেন না। কবুতর বমি করতে পারে, ভয়ের কিছু নেই। ক্রিমির ওষুধ খাওয়ানোর পর ৫ ঘণ্টার মধ্যে খাবার দিবেন না। পরদিন থেকে আবার ৩-৫ দিন লিভার টনিক দিবেন সাথে ইলেক্ট্রোমিন স্যালাইন দিতে পারেন।
প্রশ্নঃ৬- কবুতর ডিম পাড়ে না বা জমে না বা খোসা পাতলা?
প্রথমে কবুতরের বয়স ৬মাস+ নিশ্চিত করতে হবে। বয়স ঠিক থাকলে নর মাদিকে কমপক্ষে ১৫ দিন আলাদা করে রাখুন। এসময় ই-সেল সিরাপ ১.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে খাওয়াবেন অথবা নরকে ই ক্যাপ ২০০ ক্যাপসুল এবং মাদিকে কড লিভার অয়েল ক্যাপসুল একটা করে একদিন পর পর খাইয়ে দিবেন। আর ক্যালসিয়াম কোর্স হিসাবে ক্যালপ্লেক্স সিরাপ ১.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াবেন। তাতেও কাজ না হলে নর-মাদি পরিবর্তন করে দেখতে পারেন। এছাড়া কবুতরের পায়ুপথের আশেপাশের পালক, পায়ের মুজা কেটে ছোট করে দিতে পারেন তবে অবশ্যই সতর্কতার সাথে।
প্রশ্নঃ৭- কবুতর হাঁটতে পারেনা বা খুঁড়িয়ে হাটে বা ডানা ঝুলে গেছে কি করবো?
এক্ষত্রে একই নিয়মে ই সেল এবং ক্যালপ্লেক্স সিরাপ খাওয়াতে হবে ৫-৭ দিন। সাথে মাল্টি ভিটামিন কোর্স করাতে পারেন।
প্রশ্নঃ৮- কবুতরের পালক ঝরে যাচ্ছে কি সমস্যা?
কবুতরের পালক প্রাকৃতিক নিয়মে ঝরে যায় আবার নতুন পালক গজায়। এটাকে মলটিং বলে। তাছাড়া সমস্যা মনে হলে খোপে তেলাপোকা ও ইঁদুর আছে কিনা খেয়াল করুন। সাথে জিংক জাতীয় যেমন জিসভেট সিরাপ ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন খাওয়াবেন। উকুন হলেও অনেক সময় পালক ঝরে যায়।
প্রশ্নঃ৯- কবুতরের গায়ে উকুন ও মাছি কিভাবে দুর করবো?
আইভার মেকটিন বা ইমেকটিন ভেট ওষুধটি কবুতরের ঘাড়ে, দুই ডানায়, পিঠ ও লেজে এক ফোঁটা করে মোট পাঁচ ফোঁটা দিবেন। অবশ্যই অবশ্যই চামড়ায় দিতে হবে এবং ওষুধ দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন কবুতর গোসল না করে বা বৃষ্টিতে না ভিজে। প্রতিরোধ হিসেবে মাঝে মাঝে নিম পাতা সেদ্ধ পানি বা পটাশ পানিতে গোসল দিতে পারেন।
প্রশ্নঃ১০- বাচ্চার সাইজ ছোট বড় কিভাবে সমান হবে?
কবুতর ডিম আগে পরে পাড়ে এবং বাচ্চাও আগে পরে ফুটে তাই সাইজ ছোট বড় হয়। বড় হলে এমনিই সমান হয়ে যায়। তাছাড়া প্রথম ডিমটি পাড়ার পর ওটা তুলে নিয়ে প্লাস্টিকের ডিম দিতে পারেন। দ্বিতীয় ডিমটি পাড়ার পর প্লাস্টিকের ডিম তুলে আগের আসল ডিমটি দিয়ে দিবেন।
প্রশ্নঃ১১- নর মাদি চিনবো কিভাবে?
নর মাদি চেনা প্রধানত অভিজ্ঞতা ও সময়ের ব্যাপার। এছাড়া চেনা খুবই কষ্টকর। অভিজ্ঞতা হলে আপনি কবুতর ধরলেই বা দেখলেই চিনবেন। কিন্তু নতুনদের জন্য কিছু সাধারন উপায় বলে দেওয়া হলঃ
নরঃ সাইজে একটু বড় হবে, আক্রমণাত্মক হবে, ভয় কম থাকবে। ঘুরে ঘুরে গলা ফুলিয়ে ডাকবে। পায়ুপথ দেখতে অনেকটা হাসির চিহ্নের মত হবে। পানি খাওয়ার সময় পুরো ঠোঁট ডুবিয়ে খাবে। পায়ের আঙ্গুল মাঝেরটা অন্য দুইটার তুলনায় একটু বড় হবে। ঠোঁট ধরলে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। আর বুকের নিচে-পায়ুপথের উপরে “V” শেপ আকৃতির হাড়ের মাঝে ফাকা তুলনামূলক কম থাকবে।
মাদিঃ সাইজে একটু ছোট হবে, আক্রমণাত্মক না। ভয় বেশী থাকবে কিন্তু খোপে হাত দিলে ঠোকর দিবে। পায়ুপথ দুঃখের চিহ্নের মত হবে। নরের মত উচ্চস্বরে ডাকবে না, আস্তে আস্তে অস্পষ্টভাবে ডাকবে। ঠোঁট পুরো ডুবিয়ে পানি খাবে না। ঠোঁট ধরলে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে না। পায়ের আঙ্গুল সবগুলোই প্রায় সমান হবে। আর বুকের নিচে-পায়ুপথের উপরে “V” শেপ আকৃতির হাড়ের মাঝে ফাকা তুলনামূলক বেশী থাকবে।
প্রশ্নঃ১২- কবুতর ঝিমায় বা চুপচাপ বসে থাকে কি হয়েছে?
কবুতর একটা রক্ত মাংসের প্রানি। তারও ভালো লাগা মন্দ লাগা আছে। একটা কবুতর চুপচাপ বসে আছে মানেই সে অসুস্থ না। সাধারনত অত্যধিক গরম পড়লে, পানি শুন্যতা হলে, ভিটামিন জনিত দুর্বলতা থাকলে, ক্রিমি হলে কবুতর ঝিমায়। অসুস্থ মনে হলে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করে রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে।
প্রশ্নঃ ১৩- কবুতরের পক্স বা গুঁটি হয়েছে কি চিকিৎসা দিবো?
পক্স বা গুঁটি হওয়ার প্রধান কারন মশার কামড়। তাই লফট থেকে মশা দুর করুন। পক্স বা গুঁটি হলে ওই জায়গাটা হেক্সিসল দিয়ে পরিষ্কার করে পভিসেভ ক্রিম লাগিয়ে দিবেন দিনে দুইবেলা করে। এই ক্রিম যেন চোখে বা মুখে না যায়।
প্রশ্নঃ১৪- কবুতরের চোখ উঠে, ফুলে যায়, পানি পড়ে কি করবো?
অনেক সময় ঠাণ্ডা লাগলে চোখে পানি আসে। তাছাড়া চোখ উঠলে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পরিষ্কার করে গেটিসন/ সিপ্রোসিন ড্রপ এক ফোঁটা করে তিনবেলা দিবেন।
প্রশ্নঃ১৫- কিভাবে বুঝবো কবুতর ডিম পাড়বে বা ডিম দেওয়ার লক্ষন কি?
কবুতর ডিম দিতে হলে মেটিং সফল হতে হবে। মেটিং শুরু করার পর থেকে নতুন এডালট কবুতরের ১.৫-২ মাস লাগতে পারে। আর রানিং কবুতরের ৭-১২ দিন। মাদি কবুতর ডিমে আসলে নর কুটা টানবে, বাসা রেডি করবে, ঘন ঘন মেটিং করবে। আরো সময় ঘনিয়ে আসলে নর মাদি কে ঠুকরাতে বা ঠেলতে থাকবে, খোপে বা হাড়িতে বসানোর চেষ্টা করবে। খেতে দিবে না। নর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। তাহলে বুঝবেন ৩-৪ দিনের মধ্যেই ডিম দিবে।
এছাড়া আর কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানাতে পারেন আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। উপরে আমি যেসব ওষুধের নাম বলেছি সে ওষুধই ব্যবহার করতে হবে বা সেভাবেই করতে হবে এমন কোন কথা নেই। আপনি আরো অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে অন্য ওষুধ দিয়ে অন্যভাবেও চিকিৎসা করতে পারবেন।
তাছাড়া লফট পরিষ্কার রাখলে, ভালো মানের খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করলে ৯৫% রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। বাজার থেকে নতুন কবুতর এনেই লফটে তুলবেন না। কিছুদিন আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ করে লফটে ছাড়ুন। লফটের কোন কবুতর অসুস্থ মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে ফেলুন। লফটে ঢুকার আগে আপনি নিজে জীবাণুমুক্ত হয়ে নিন। আবার কোন কবুতর চুপচাপ বা অসুস্থ মনে হলে যার তার পরামর্শে দেদারসে ওষুধ খাওয়ানো শুরু করবেন না, বুঝে শুনে পদক্ষেপ নিন।
শেষকথাঃ কবুতরকে পণ্য না ভেবে একটা প্রানি হিসেবে ভালবাসুন। মন থেকে সৎ থাকুন। প্রতারনা, ধান্ধাবাজি, দালালী মনোভাব পরিত্যাগ করুন।( ধন্যবাদ)