01/10/2023
আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে মুরগির বাচ্চা ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা
☞ব্রুডিং কি?
মুরগি বাচ্চা যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তার শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী অংগগুলো অপূর্ণ থেকে যায়। ফলে সে তার নিজের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এই সময়টাতে বাচ্চাকে কৃত্রিম ভাবে কিংবা প্রাকৃতিক ভাবে মা মুরগির মাধমে তাপ দেয়ার ব্যবস্থাই হচ্ছে ব্রুডিং।
অন্যভাবে বলা যায়, একটি সদ্য জন্মানো মুরগির বাচ্চাকে ধাপে ধাপে বাহিরের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য, ক্রমহ্রাসমান হারে যে তাপ প্রদান করা হয় তাকে ব্রুডিং বলে।
তবে বিশদভাবে বলতে গেলে, ব্রুডিং শুধুমাত্র তাপপ্রদান ব্যবস্থাই নয়, বরং এখানে নির্দিষ্ট বয়সে নির্দিষ্ট মাত্রায় তাপ দেওয়ার পাশাপাশি পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, খাবার ও পানির ব্যবস্থা সর্বোপরি মুরগির বাচ্চার জন্য একটি অনুকূল ও আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করেতে হয়।
☞ব্রুডিং কতদিন করতে হয়?
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় গ্রীষ্মকালে ব্রয়লার, সোনালী, লেয়ার মুরগি, হাঁস ও কোয়েল পাখির ক্ষেত্রে পরিবেশ ও বাচ্চার অবস্থার উপর ভিত্তি করে বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ২ সপ্তাহ থেকে ৩ সপ্তাহ আর শীতকালে এ সময়সীমা আরো কিছুদিন বেড়ে যায়। সাধারণত শীতে ব্রয়লার, সোনালী, লেয়ার মুরগি, হাঁস ও কোয়েল পাখির ক্ষেত্রে ৩ সপ্তাহ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ব্রুডিং করা উচিত।
☞ সঠিক ব্রুডিং এর উপকারিতাঃ
• বাচ্চার মৃত্যুর হার কম হয়।
• দ্রুত নাভী শুকাতে সঠিক ব্রুডিং ব্যবস্থাপনার ভূমিকা রয়েছে।
• বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
• শারীরিক গঠন সঠিকভাবে হয়।
• সঠিক বয়সে সর্বোচ্চ ওজন আসে।
• সঠিক সময়ে ডিমে আসে।
• ব্রুডারে সমান তাপমাত্রা থাকায় সকল বাচ্চার খাদ্য ও পানি গ্রহনের পরিমান সমান থাকায় সকল মুরগি সম-আকৃতির এবং সম-ওজনের হয়।
• বিভিন্ন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বেড়ে যায়।
• জীনগত বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ বিকাশ ঘটে।
• সর্বোপরি প্রতিকুল আবহাওয়া থেকে বাচ্চাকে রক্ষা করে।
☞ সঠিক ব্রুডিং না করার ক্ষতিকর দিকসমূহঃ
• ব্রুডিং সঠিক না হলে বাচ্চার মৃত্যুহার বেড়ে যাবে।
• ব্রুডারে বাচ্চা সঠিক তাপমাত্রা না পেলে শক্তি হারাবে এবং দূর্বল হয়ে মারা যাবে।
• ব্রুডিং সঠিক না হলে বাচ্চা খাদ্য ও পানি কম খাবে।
• ব্রুডিং সঠিক না হলে বাচ্চার কাঙ্ক্ষিত ওজন আসবে না।
• ব্রুডিং সঠিক না হলে বাচ্চা থেকে সর্বোচ্চ প্রোডাকশন পাওয়া যাবে না।
• ব্রুডিং সঠিক না হলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সর্বোচ্চ হবে না।
• ব্রুডিং সঠিক না হলে বাচ্চার কুসুম সঠিকভাবে শোষিত হবে না। ফলে ই-কোলাই সহ অন্যান্য জীবাণু দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয়ে থাকে।
• ব্রুডিং সঠিক না হলে পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা দেয়া দিতে পারে। যেমনঃ প্রোল্যাপ্স, সঠিক সময়ে ডিমে না আসা, পিক প্রোডাকশন না পাওয়া।
☞ মুরগির বাচ্চা ব্রুডিং এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণঃ
সঠিকভাবে বাচ্চা ব্রুডিং এর জন্য বেশ কিছু উপকরণের সমন্বয় আবশ্যক। ব্রুডিং এর পরিবেশ ঠিক রাখতে নিম্নলিখিত উপকরণ গুলো প্রয়োজন হয়।
• চিকগার্ড
• হোবার
• লিটার
• পত্রিকা/কাগজ/পাটের বস্তা
• খাবার ও পানির পাত্র
• থার্মোমিটার
• আর্দ্রতা মিটার (হাইগ্রোমিটার)
• ইলেকট্রিক বাল্ব
১। চিক গার্ড কি?
বাচ্চা যাতে তাপের উৎস হতে দূরে সরে না যেতে পারে সেজন্য যে বেস্টনি বা বেড়া দেওয়া হয়-সেটাকেই চিকগার্ড বলে। আমাদের দেশে সাধারণত প্লেনশীট দিয়ে চিক গার্ড তৈরি করা হয়। তবে চাইলে চিক গার্ড হিসাবে কাগজের কার্টুন, বাঁশের চাটাইও ব্যবহৃত হয়। মোটকথা হচ্ছে- ব্রুডিং এর সময় বাচ্চাকে একটা গন্ডির মধ্যে আটকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
আদর্শ চিকগার্ড কেমন হওয়া উচিত?
• উচ্চতাঃ চিক গার্ড বেশী ছোট বা বেশী বড় দেওয়া যাবেনা। বেশী ছোট দিলে বাচ্চা পিষ্ট হয়ে মারা যাবে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশী বড় হলে বাচ্চা তাপের উৎস হতে দূরে সরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পরবে। আদর্শ চিক গার্ডের উচ্চতা হচ্ছে ১৮ ইঞ্চি। তবে শীতের সময়ে চিক গার্ডের উচ্চতা ২৮ ইঞ্চি পর্যন্ত করা যেতে পারে।
• ব্যাস/ব্যাসার্ধঃ ৫০০ বাচ্চা ব্রুডিং এর জন্য একটি চিক গার্ডের ব্যাস হবে ১০-১২ ফুট অর্থ্যাৎ ব্যাসার্ধ হবে ৫-৬ ফুট।
• লম্বাঃ ৫০০ বাচ্চা ব্রুডিং এর জন্য একটি চিক গার্ড লম্বায় হবে প্রায় ৩২-৩৮ ফুট। যেটি গোলাকার করল প্রায় ব্যাস হবে ১০-১২ ফুট অর্থ্যাৎ ব্যাসার্ধ হবে ৫-৬ ফুট।
• ব্রুডারে বাচ্চার জায়গার পরিমাণঃ প্রথমাবস্থায় চিক গার্ডে প্রতিটি মুরগির বাচ্চার জন্য ০.২-০.৩ বর্গফুট জায়গা দিতে হবে। বাচ্চার বয়স ১ সপ্তাহ পার হলে এই জায়গার পরিমাণ দ্বিগুণ এবং ২ সপ্তাহ পার হলে জায়গার পরিমাণ তিন গুণ করে দিতে হবে।
২। হোবার কি?
যখন ব্রুডিং এ বাচ্চাকে তাপ দেয়া তখন তাপ যাতে উপরের দিকে উঠে না যায় সেজন্য বাল্বের উপর যে ঢাকনা ব্যবহার হয়, যার সাথেই বাল্ব সংযুক্ত থাকে সেটাই হচ্ছে হোবার। বাংলাদেশের বাজারে প্লেনশীটের তৈরি রেডিমেড ছোট আকারের যে হোবার গুলো পাওয়া যায় তার ব্যাস সাধারণত ৫ ফুট হয়। এরকম একটা হোবারে ৩০০-৫০০ টি বাচ্চা ব্রুডিং করা যায়। হোবার টি চিক গার্ডের ঠিক মাঝ বরাবর উপর থেকে রশি দিয়ে এমনভাবে স্থাপন করতে হয়, যেন রশি টেনে কপিকলের মতো হোবার টেনে উপরে-নিচে উঠা-নামা করানো যায়। চিক গার্ডের চারিদিকের প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের দিকে হোবারের দূরত্ব হবে ২.৫-৩ ফুট।
৩। বাচ্চার বিছানা বা লিটারঃ
বাচ্চাকে একটি আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়ার জন্য মুরগি রাখার ঘরের মেঝেতে যে উপাদান গুলো বিছিয়ে দেওয়া হয় সেটাকেই মুরগির বিছানা বা লিটার বলে। আমাদের দেশে সাধারণত ধানের তুষ লিটার হিসাবে সবচেয়ে বেশী ব্যবহার হয়। তবে লিটার হিসেবে বালু, কাঠের ভূষি, কাঠের বাকল, আখের ছোবড়া, ধান বা গমের খড়, বাদামের খোসা, ভূট্টা সংগ্রহরে পরে শুকনো গাছ, সরিষা সংগ্রহের পর গাছ ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। ব্রুডিং এ কাঠের ভূষি বা কাঠের গুঁড়া ব্যবহার না করাই উত্তম। এতে সহজের জমাট বাঁধা ও এমোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়ে যায়। মোটকথা- লিটার হিসাবে এমন কিছু নির্ধারণ করতে হবে যা সহজেই আদ্রতা শোষণ করে নিতে পারে এবং শুকনো থাকে।
লিটারের পুরুত্ব কেমন হবে?
সাধারণত গ্রীষ্মকালে ২ ইঞ্চি পুরুত্বের লিটার আর শীতকালে ৩-৪ ইঞ্চি পুরুত্বের লিটার দিলেই যথেষ্ট। বিশেষ সতর্কতা- ব্রুডিং এ লিটার হিসাবে কাঠের ভূষি ব্যবহার করা কোন অবস্থাতেই ঠিক নয়।
৪। পত্রিকা/কাগজ/পাটের বস্তাঃ
ব্রুডিং এ ১ম দুই-তিন দিন বাচ্চাকে পুরাতন জীবানুমুক্ত খবরের কাগজের উপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হয়। এসময় বাচ্চা খুব নাজুক থাকে বিধায় পাত্র হতে খাবার খাওয়ার উপযোগী থাকেনা। খবরের কাগজ ছাড়াও ব্রাউন পেপার বা যেকোন বড় কাগজ অথবা পাটের বস্তা ব্যবহার করা যায়।
৫। খাবার ও পানির পাত্রঃ
ব্রুডিং এ বাচ্চার খাবার ও পানির পাত্র তুলনামুলক ছোট ও কম উচ্চতার দিতে হবে। প্রতি ৪০-৫০টি বাচ্চার জন্য ১ টা খাবারের পাত্র (চিক ফিডার – ২.৫ ফুট লম্বা) এবং প্রতি ৪০-৫০ টি বাচ্চার জন্য ১ টি পানির পাত্র (২ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন) দিতে হবে। তা নাহলে বাচ্চা খাবার ও পানি খেতে প্রতিযোগীতার সম্মুখিন হবে এবং অপেক্ষাকৃত দূর্বল বাচ্চাগুলো খাবার খেতে পারবেনা বা অনেক সময় চাপে মারা যেতে পারে।
৬। থার্মোমিটারঃ
ব্রুডিং এর উপকরণ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে থার্মোমিটার। অথচ সস্তার এই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি সম্পর্কে আমাদের দেশের খামারিরা খুবই উদাসীন। পোল্ট্রিতে সফলতার পূর্ব শর্ত যদি হয় ব্রুডিং; তাহলে ব্রুডিং এ সফল হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। আর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য থার্মোমিটারে মেপে দেখা আবশ্যক। বাজারে পেটশপ বা ভেটেরিনারি শপ গুলোতে খুব স্বল্পমূল্যে কাঠের বা প্ল্যাস্টিকের ফ্রেমের থার্মোমিটার অথবা উন্নতমানের ডিজিটাল টেম্পারেচারমিটার (এগুলোতে একই সাথে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা দেখা যায়) পাওয়া যায়।
৭। হাইগ্রোমিটারঃ
ব্রুডিং এ আদ্রতা পরিমাপের জন্য হাইগ্রোমিটার বা আদ্রতা পরিমাপক ব্যবহার করতে হয়। হাইগ্রোমিটার হিসাবে আমাদের দেশে যে ডিভাইস গুলো পাওয়া যায় তা- এইচটিসি-১, এইচটিসি-২, হিউমিডিটি মিটার ইত্যাদি নামে পরিচিত। এগুলো দিয়ে একই সাথে ব্রুডিং ঘরের তাপমাত্রা ও আদ্রতা পরিমাপ করে প্রয়োজনে কম বা বেশী করে নিতে হয়।
৮। ইলেকট্রিক বাল্বঃ
ব্রুডিং এ বয়স অনুযায়ী সঠিক তাপমাত্রা পেতে ব্রুডারের হোবারে নির্দিষ্ট পয়েন্টে ইলেকট্রিক বাল্ব লাগানো হয়। সাধারণত হিটের উৎস হিসেবে ফিলামেন্ট বা ইনক্যান্ডেসসেন্ট বা নরমাল লাল আলোর বাল্ব ব্যবহৃত হয়। তবে বর্তমানে বিদ্যুৎ খরচ কমাতে উন্নতমানের ইনফ্রারেড ও সিরামিক হিট বাল্ব বাজারে পাওয়া যায়, যা প্রায় একই বিদ্যুৎ খরচে ৭-১০ গুন বেশি তাপ উৎপন্ন করত সক্ষম।
১ টা ৫০০ বাচ্চার ব্রুডারে সাধারণত ২০০ ওয়াটের ৪ টা নরমাল লাল আলোর বাল্ব লাগাতে হয়। অন্যদিকে ইনফ্রারেড হিট বাল্ব ব্যবহার করলে মাত্র ১ টি ২০০ ওয়াটের ইনফ্রারেড এবং ১ টা নরমাল ১০০ ওয়াটের বাল্বই যথেষ্ট।
তবে, প্রকৃতঅর্থে ব্রুডিং এ বাল্বের সংখ্যা বা ওয়াট দিয়ে বিবেচনা করা উচিত নয়। ব্রুডিং এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট বয়সে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রদান। এবং এই তাপমাত্রা বজায় রাখতে যত ওয়াট অথবা যতটি বাল্বই দরকার হোক না কেন; তত ওয়াট বা ততগুলো বাল্বই সেট করতে হবে। প্রয়োজনে হোবারের উচ্চতা কমিয়ে বাড়িয়ে তাপমাত্রা এডজাস্ট করতে হবে।
☞ ব্রুডার যেভাবে প্রস্তুত করতে হবেঃ
১। প্রথমেই যে জায়গায় ব্রুডিং করা হবে সেখানে ২-৩ ইঞ্চি পুরো করে জীবাণুমুক্ত লিটার বিছিয়ে নিতে হবে। ব্রুডিং এ লিটার হিসাবে ধানের তুষ সবচেয়ে ভাল। ভুল করেও ব্রুডিং এ লিটার হিসাবে কাঠের গুড়া দেয়া যাবে না। লিটার হিসাবে কাঠের গুড়া খুবই ক্ষতিকর। কাঠের গুড়ার কণাগুলো অতিক্ষুদ্র হওয়ায় তা বাতাসে উড়ে এবং বাচ্চার নাক মুখ দিয়ে প্রবেশ করে ইনফেকশন সৃষ্টি করে। ফলে বাচ্চা সর্দি ও নিউমোনিয়া রোগে ভুগে। ব্রুডিং এ কাঠের গুড়া ব্যবহার অনুচিত। ধানের তুষ না পাওয়া গেলে পরিবর্তে চটের বস্তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
২। তুষ বিছানোর পর বাচ্চার পরিমাণ অনুপাতে চিকগার্ড বসাতে হবে। চিকগার্ড বসানোর পর জীবাণুমুক্ত পুরাতন খবরের কাগজ একটা একটা করে স্তরে স্তরে বিছিয়ে দিতে হবে। এভাবে ৬-৮টি পত্রিকার স্তর তৈরি করা যেতে পারে। এভাবে স্তরে স্তরে বিছানোর কারন হচ্ছে একটা স্তর যখন নোংরা হয়ে যাবে, তখন উপর হতে পত্রিকার ১ম স্তরটি উঠিয়ে ফেললে নিচের পরিষ্কার পত্রিকার ২য় স্তর বেরিয়ে আসবে। এভাবে ব্রুডারের পরিচর্যা করা সহজ হয়। বাচ্চা ব্রুডারে আনার অন্তত ১-২দিন আগে ব্রুডার সেটআপ করে রাখতে হবে।
৩। বাচ্চার পরিমাণের অনুপাতে হোবার সেট করতে হবে। প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা অর্থাৎ ৩৫ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপ যাতে হয় সে অনুযায়ী হোবারে বাল্ব দিতে হবে। বাচ্চা ব্রুডারে দেওয়ার অন্তত ২-৪ ঘন্টা আগে হোবার জ্বালিয়ে রাখতে হবে। আগেই নিশ্চত হতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়।
৪। বাচ্চা আনার ২-১ দিন আগেই খাবার ও পানির পাত্র জীবানুনাশক যেমনঃ টিমসেন, জিপিসি-৮, ভাইরোসিড, পভিসেপ-১০%, পটাশ, ভারকন এস, ফার্ম-৩০ ইত্যাদি মেশানো পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে রেডি রাখতে হবে।
৫। ব্রুডিং এ চিক গার্ডের ভিতরে একপাশে ভূমি হতে ২-৩ ইঞ্চি উপরে থার্মোমিটার ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সতর্কতাঃ বেশী উপরে বা বেশী নিচে এবং হোবারের ঠিক নিচে থার্মোমিটার রাখা যাবেনা। তাহলে সঠিক তাপ পরিমাপ করা সম্ভব হবেনা।
৬। ব্রুডিং ঘরের আদ্রতা পরিমাপের জন্য ঘরের একপাশে হাইগ্রোমিটার ঝুলিয়ে রাখতে হবে। আদ্রতা কম হলে ঘরে ১ টা গামলা বা বালতিতে পানি ভরে রাখলে আদ্রতা বেড়ে যাবে। সাধারণত বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে এবং লিটার অতিরিক্ত ভিজে গেলে আদ্রতা অতিরিক্ত বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে লিটার পরিবর্তন করে নতুন লিটার দিলে আদ্রতা স্বাভাবিক হয়ে যায়।
৭। শীতকালে ব্রুডিং এ প্রয়োজনীয় তাপ পেতে অনেকে ব্রুডারের উপরাংশ ঢেকে দেয়। যা অনেক বড় একটা ভুল। এমনটা কখনোই করা যাবেনা। প্রয়োজনে বাল্ব বাড়িয়ে দিয়ে তাপ বাড়াতে হবে।
☞ মুরগির বাচ্চার ব্রুডিং তাপমাত্রাঃ
বয়স (সপ্তাহ) তাপমাত্রা (ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা (ডিগ্রি ফারেনহাইট)
১ম সপ্তাহ ৩৫ ডিগ্রি ৯৫ ডিগ্রি
২য় সপ্তাহ ৩২.২ ডিগ্রি ৯০ ডিগ্রি
৩য় সপ্তাহ ২৯.৫ ডিগ্রি ৮৫ ডিগ্রি
৪র্থ সপ্তাহ ২৭.৬ ডিগ্রি ৮০ ডিগ্রি
৫ম সপ্তাহ ২৩.৮৮ ডিগ্রি ৭৫ ডিগ্রি
সাধারনত ২ সপ্তাহের বেশি ব্রুডিং করা লাগে না। তবে শীতের দিনে ব্রুডিং প্রায় চার-পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত করতে হয়। ব্রুডিং তাপমাত্রার গোপন কথা হচ্ছে যে, ব্রুডিং যত সপ্তাহই করা লাগুক না কেন। প্রথম সপ্তাহের যে তাপমাত্রা দেয়া লাগে। এরপরে প্রতি সপ্তাহে ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট করে কমাতে হবে।
☞ ব্রুডারে বাচ্চা ছাড়ার সময় যা যা করতে হবেঃ
বাচ্চা পরিবহন করে খামারে নিয়ে আসার পরে বাচ্চা ব্রুডারে ছাড়ার সময় আপনাকে বিশেষ সতর্কতা মানতে হবে-
১। ব্রুডারের সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন লিটার পেপার, চিকগার্ড, পানি, হোভার, খাবারের পাত্র সব তিন ঘন্টা আগেই বসিয়ে নিতে হবে যথাযথ স্থানে।
২। হোভারের লাইট দুই-তিন ঘন্টা আগেই জ্বালিয়ে নিন এবং একঘন্টা পর থার্মোমিটারের রিডিং পরীক্ষা করতে হবে।
৩। বাচ্চা আসার আধঘন্টা আগে পানিতে দ্রবণীয় কোন প্রোবায়েটিক দিয়ে ব্রুডারের চারপাশে এবং ভিতরে পেপারে হালকা স্প্রে করে দিতে হবে।
৪। বাচ্চা আসার ১০ মিনিট আগেই পানির পাত্র এবং খাবার পাত্র যথাযথ জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে।
৫। বাচ্চা আসার পর বাচ্চার বক্স সহ কিছুক্ষণ শেডের মধ্যে রেখে দিতে হবে। বাচ্চা এনেই তড়িঘড়ি করে ছেড়ে দেয়া যাবে না। প্রথমে বাচ্চার কার্টুন ব্রুডার ঘরে ১০-১৫ মিনিট রাখতে হবে। এতে করে বাচ্চা গুলা ব্রুডারের তাপমাত্রার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
৬। তারপর বাচ্চাসহ প্রতিটি বক্সের ওজন করুন এবং খাতায় লিপিবদ্ধ করতে হবে। বক্স নম্বর সহ পরবর্তীতে খালি বক্সের ওজন বাদ দিলে একদিনের বাচ্চার ওজন পাওয়া যাবে।
৭। এর পর প্রতিটি ব্রুডারে গুনে গুনে বাচ্চা ছেড়ে দিতে হবে এবং বাচ্চার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৮। যদি বাচ্চা দুর্বল থাকে তা হলে পৃথক করতে হবে এবং ভিটামিন-সি ও গ্লুকোজের পানি ফোটায় ফোটায় খাওয়াতে হবে।
৯। বাচ্চা সবল থাকলে প্রথম দুই ঘন্টা শুধুমাত্র জীবানুমুক্ত সাদা পানি দিতে হবে। বাচ্চা দুর্বল থাকলে গ্লুকোজের পানি দিতে হবে। এছাড়া বাচ্চাকে সুস্থ রাখতে প্রথম ৩ দিন প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
১০। বাচ্চা আসার ১০ মিনিট পর খাবার দিন এক্ষেত্র শুধুমাত্র প্রথমবার পেপারে ছিটিয়ে দিবেন এবং এর পর থেকে অবশ্যই ট্রেতে খাবার দিতে হবে। বাচ্চা সুস্থ-সবল থাকলে খাবার ও পানি এক সাথেই দেয়া যেতে পারে।
১১। একঘন্টা পর অন্তত ১০% বাচ্চার খাবারের থলি পরীক্ষা করতে হবে। বাচ্চার পায়ের তলা আপনার গালে লাগিয়ে দেখুন কুসুম গরম আছে কিনা। যদি থাকে তা হলে বুঝবেন বাচ্চার ব্রুডিং যথাযথ হচ্ছে।
১২। দুইঘন্টা পর চাইলে ভিটামিন-সি ও গ্লুকোজের পানি দিতে পারেন, সাদা পানি দিলেও চলবে।
১৩। বাচ্চার অবস্থা ৩ ঘন্টা পরপর পর্যবেক্ষণ করতে হবে তাপ বেশী হচ্ছে কিনা। কোন সমস্যা থাকলে সমাধান করতে হবে এবং বাচ্চা মৃত থাকলে সরিয়ে ফেলতে হবে। খাবার পানি শেষ হলে খাবার পানি দিতে হবে। পেপার ভিজে গেলে পাল্টে দিতে হবে।
১৪। ২৪ ঘন্টা পর পেপার সম্পূর্ন ভাবে সরিয়ে ফেলবেন। পর্দা হালকা নামিয়ে গ্যাস বের করে দিতে হবে।
ডাঃ শ্রাবণ হাসান সজল
ডিভিএম, এমএস ইন প্যাথলজি (পবিপ্রবি)