10/09/2022
🚩ইক্লেকটাস প্যারোট
ইক্লেকটাস প্যারোট সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সুম্বা, নিউ গিনি এবং কাছাকাছি দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অস্ট্রেলিয়া এবং মালুকু দ্বীপপুঞ্জের একটি স্থানীয় পাখি। জার্মান প্রানিবিদ্যাবিশারদ Philipp Ludwig Statius Müller ইক্লেকটাস প্যারোট এর দ্বিপদী নামকরণ বা বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন Eclectus roratus । গড়ে ১৪ ইঞ্চি আকারের চমৎকার এই পাখিটি তার বুদ্ধিমত্বা, প্রেমময় ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ক্ষমতা, সুন্দর রং এর কারনে সারা বিশ্বে তোতা বা টিয়া জাতীয় পাখিদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়। ইক্লেকটাস প্যারোট এর পুরুষ পাখি গড়ে ৪৩০ গ্রাম ও নারী পাখি গড়ে ৪৫২ গ্রাম হয়ে থাকে। সঠিক যত্ন ও সুষম খাদ্য দিলে খাঁচায় ইক্লেকটাস প্যারোট কে ৩০ বছর বা এর অধিক বাঁচানো সম্ভব।
পাখির জন্য সঠিক বাসস্থানঃ
ইক্লেকটাস প্যারোট কে খাঁচায় পালার থেকে বাড়ির আঙিনায় বা ছাদে শেড করে পালা উত্তম। কারন পাখি দানা মেলে উড়লে ডানা ও শরীরের পেশিগুলোর ব্যায়াম হয়, ফলে পাখি প্রানবন্ত ও সুস্থ থাকে। সে ক্ষেত্রে ১ জোড়া ইক্লেকটাস প্যারোট এর জন্য কমপক্ষে ১২X৬X১০ ফিট (দৈর্ঘXপ্রস্থXউচ্চতা) এর শেড তৈরি করে দিতে হবে। অথবা ১ জোড়া পাখির জন্য কমপক্ষে ৬X৩X৫ ফিটের খাঁচা দিতে হবে। পাখির বসার জন্য খাঁচা বা শেড এর দুই পাশে সমান্তরালভাবে ৩ সে.মি ডায়ামিটার বা ১.২ ইঞ্চি মোটা কাঠের লাঠি বা ইউক্যালিপ্টাস গাছের অথবা নিম গাছের ডাল শক্তভাবে আটকিয়ে দিতে হবে।
খাদ্যভাসঃ
ইক্লেকটাস প্যারোট এর সুষম খাদ্যের তালিকায় ৬০% শাক-সবজি ও ফল-মূল; ২০% অঙ্কুরিত বীজ, ডাল জাতীয় বীজ ও শিমের বীজ; ১০% শস্য দানা ও বীজ এবং বাকি ১০% বাদাম থাকা বাঞ্ছনীয়। গাজর, বরবটি, ফুলকপি, ব্রকলি, শসা, বিট, লেটুস, মিষ্টি আলু, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা মরিচ, কচি ভুট্টা, মটরশুটি, পালং শাক, সেলেরি, এসপারাগাস বা শতমূলী ইত্যাদি শাক সবজি পাখিকে দেয়া যায়। আপেল, কমলা, পেঁপে, বেদানা, আঙ্গুর, রক মেলন, হানি ডিউ, আম, লিচু, তরমুজ, চেরি, স্ট্রবেরি, কলা, খেজুর, ডুমুর, পেয়ারা সহ যে কোন ফল বীজ ছাড়া দেয়া যাবে। ইক্লেকটাস প্যারোট সহ যে কোন বড় আকারের পাখির খাবারে ফল থাকা বাধ্যতামূলক, কারণ ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। যা পাখির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ভিটামিন, মিনারেল ও এনজাইমের চাহিদা পূরণ করে। ইক্লেকটাস প্যারোট ফল এতটাই পছন্দ করে যে কিছু কিছু দ্বীপে ইক্লেকটাস প্যারোট কে ফল খেকো কীট বা পোকা নামে অবহিত করা হয়। মুগ, সূর্যমুখী ফুলের বীজ, ছোলা, গম, যে কোন শিম বীজ ইত্যাদি অঙ্কুরিত করে পাখিকে দেয়া উচিৎ, আস্ত বীজ বা ডাল জাতীয় বীজ এর থেকে ঐ বীজের অঙ্কুরিত বীজে ভিটামিন, মিনারেল ও পুষ্টিমান বেশি হয়ে থাকে। ছোলা, মুগ ইত্যাদি ডাল জাতীয় বীজ ও শিম জাতীয় বীজ ভিজিয়ে রেখে সিদ্ধ করে পাখিকে দেয়া উচিৎ। ইক্লেকটাস প্যারোট কে সাধারণত মিলেট, ক্যানারি, সূর্যমুখী ফুলের বীজ, গ্রে স্ট্রাইপ সূর্যমুখী, কুসুম ফুলের বীজ, হেম্প বীজ, বাকহুইট, মিষ্টি কুমড়ার বীজ, গম ও যব ইত্যাদি শস্য দানা ও বীজ এর সুষম মিশ্রণ দেয়া যেতে পারে। কাঠ বাদাম, পেস্তা বাদাম, কাজু বাদাম, আখরোট, পিক্যান, পাইন নাট, ব্রাজিলিয়ান নাট ও হ্যাজেল নাট ইক্লেকটাস প্যারোট কে দেয়া যেতে পারে, বাদাম পাখির জন্য ক্যালসিয়াম সহ প্রোটিন, বিভিন্ন মিনারেল ও এনজাইম প্রদান করে থাকে। যা প্রজজন মৌসুমে পাখির জন্য ভালো ফ্যাট, প্রোটিন, মিনারেল ও এনজাইমের উৎস হতে পারে। তবে পাখিকে পিনাট বা চীনাবাদাম দেয়া উচিৎ না। ইক্লেকটাস প্যারোট কে এভোকেডো, ফলের বীজ(বিশেষ করে আপেল), লবণ, চিনি সহ দুদ্ধজাত যে কোন খাদ্য দেয়া উচিৎ না।
লিঙ্গ সনাক্তকরণ ও বয়স নির্ধারণঃ
ইক্লেকটাস প্যারোট এর লিঙ্গ সনাক্তকরন এর জন্য ডিএনএ টেস্ট করার প্রয়োজন হয় না, কারন ইক্লেকটাস প্যারোট পাখি দেখে ই নারী-পুরুষ চেনা যায়। এমনকি বাচ্চা অবস্থায় শরীরের পালক উঠলেই, পালক দেখে ই ছেলে নাকি মেয়ে হবে সেটা বোঝা সম্ভব। পুরুষ পাখির শরীরের বেশির ভাগ জুড়ে ই পান্না সবুজ বা পদ্ম পাতার রঙের মতো হয়ে থাকে, প্বার্শদেশ লাল ও প্রাইমারি পালক নীল রঙের হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাখির চঞ্চু বা ঠোঁটের উপরের চোয়াল কমলা রঙের ও ডগার দিকে হলুদ রং হয়ে থাকে এবং নিচের চোয়াল সম্পূর্ণ কালো। উপপ্রজাতিভেদে নারী পাখির শরীরের রং ভিন্ন হওয়ার কারণে সাধারণত নারী পাখিকে তার শরীরের রঙের ভিতিত্তে নীল, বেগুনি ও লাল শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। বেশিরভাগ উপপ্রজাতির নারী পাখির উদর বা পেট ও ঘাড়ে নীল রং হয়ে থাকে, অন্যান্য উপপ্রজাতির পেট ও ঘাড়ে বেগুনি, লাল ও লেভেন্ডার রং হয়ে থাকে। সাধারণত নারী পাখির শরীরের বেশিরভাগ রং লাল হয়ে থাকে, ডানা ও পিছনের অংশ গাঢ় রং এর হয়ে থাকে। নারী পাখির ডানার নিচে ও মেন্টেল বা ঘাড়ের অংশ জুড়ে বেগুনি রং হয়ে থাকে। নারী পাখির চঞ্চুর উপরের ও নিচের চোয়াল সম্পূর্ণ কালো হয়ে থাকে। ইক্লেকটাস প্যারোট এর লেজ কিছুটা 'U' আকৃতির মতো হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির চোখের আইরিশ হলুদ থেকে কমলা রঙের হয়ে থাকে, অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির চোখের আইরিশ গাঢ় বাদামী থেকে কালো রঙের হয়ে থাকে।
প্রজননঃ
সাধারণত ইক্লেকটাস প্যারোট এর নারী-পুরুষ গড়ে ৩ বছরের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে থাকে। তবে পুরুষ পাখি নারী পাখির তুলনায় একটু দেরিতে প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে থাকে। নারী-পুরুষ উভয় পাখিকে ৪ বছর বয়সের আগে প্রজনন করানো ঠিক হবে না। সঠিক আকারের বাসস্থান, সুষম খাদ্য ও সব কিছু ঠিক থাকলে ইক্লেকটাস প্যারোট বছরের যে কোন সময় প্রজনন করে থাকে। সাধারণত প্রজনন করার উদ্দেশ্যে পাখি ক্রয় করার সময় অল্প বয়সের পাখি নির্বাচন করা উত্তম, কারণ অভিজ্ঞ ইক্লেকটাস প্যারোট ব্রিডারগণ তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছেন অনেক সময় পুরুষ পাখি নারী পাখিকে ভয় পায়, এক সাথে খাবার খায় না, এক সাথে এক লাঠিতে বসেও না, সেক্ষেত্রে এমন পুরুষ পাখি প্রজনন করবে না। কারন ইক্লেকটাস প্যারোট বনে প্রজনন কালে একটি পুরুষ পাখি একাধিক নারী পাখিকে খাবার খাইয়ে দেয় ও একটি নারী একাধিক পুরুষের সাথে সঙ্গম বা মেটিং করে থাকে। তাই বিশ্বের অনেক অভিজ্ঞ ইক্লেকটাস প্যারোট ব্রিডারগন কলোনি করে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছেন। সেক্ষেত্রে ৩/৪ জোড়া পাখিকে বড় একটা শেড বা রুমে ছেড়ে পালন করা যেতে পারে। তবে প্রজনন মৌসুমে অবশ্যই নারী পাখির সংখ্যার তুলনায় ২/১ টা ব্রিডিং বক্স বেশি দিতে হবে। আবদ্ধভাবে প্রজনন করার ক্ষেত্রে অল্প বয়সে থেকে পাখিদের এক সাথে রাখলে, সেই জোড়া ভালো প্রজনন ফলাফল দিবে। ইক্লেকটাস প্যারোট এর নারী পাখি সাধারণত ২ টি ডিম দিয়ে থাকে, ২৮-৩০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সব থেকে মজার ব্যাপার হল ইক্লেকটাস প্যারোট এর ২ টি ডিম থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে পাখি জন্ম নেয়। বাচ্চা বড় হয়ে নিজে খাওয়া শিখে মা-বাবার থেকে আলাদা হওয়ার উপযুক্ত হতে ১১ সপ্তাহের মতো সময় লাগে। বাচ্চা ফুটে বের হলে পাখিকে প্রচুর পরিমাণে তাজা শাক-সবজি ও ফল দিতে হবে, ডিম সিদ্ধ, ভুট্টা সিদ্ধ দেয়া যেতে পারে। ইক্লেকটাস প্যারোট এর জন্য "L" আকৃতির ৩০X১৫X৩০ ইঞ্চি (দৈর্ঘXপ্রস্থXউচ্চতা) আকারের বক্স দিতে হবে। বক্স এ পাখি ঢোকার জন্য বক্সের উপরের দিকে ৩.৫ ডায়াইঞ্চি গোল মুখ করে দিতে হবে। নেস্টিং মেটেরিয়াল হিসেবে বক্সে ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতা বা নিম পাতা দিতে হবে। ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতা দেয়া ই উত্তম, কারণ ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতা বক্সে থাকা পাখি ও জন্ম নেয়া পাখির বাচ্চাকে মাইটস ও পরজীবী থেকে মুক্ত রাখবে। বেশিরভাগ বড় পাখি প্রজননকালে মারা যাওয়ার অন্যমত একটি কারন হলো ক্যালসিয়াম ও অতি প্রয়োজনীয় মিনারেল এর ঘাটতি। তাই পাখির ক্যালসিয়াম, ফসফরাস সহ অতি প্রয়োজনীয় মিনারেল এর ঘাটতি পূরণ এর জন্য কাটল ফিস বোন, ডিমের খোসা গুড়া, লাইম স্টোন গুড়া ও বিদেশি মিনারেল এর গুড়া দিতে হবে।
বাংলাদেশে ইক্লেকটাস প্যারোট ঢাকার গুলশানের সাইফুল আলম দিপু, সিলেট এর আব্দুল হান্নান ও নাহার গার্ডেন এর স্বত্বাধিকারী হামিদুল ইসলাম হামিদ সহ অনেক এ সফল ভাবে ব্রিডিং করিয়েছেন।
উপপ্রজাতিঃ
E. roratus প্রজাতির অন্তর্গত ৯ টি উপপ্রজাতি রয়েছে ইক্লেকটাস প্যারোট এর। উপপ্রজাতি গুলোর মধ্যে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভসমেয়ার এবং নিউ গিনির লাল-পার্শ্বযুক্ত উপপ্রজাতি গুলো অন্যতম। যার মধ্যে গ্র্যান্ড ইক্লেকটাস, ভসমায়ের'স ইক্লেকটাস, সুম্বা আইল্যান্ড ইক্লেকটাস, নিউগিনি রেড সাইডেড ইক্লেকটাস, সলেমন আইল্যান্ড ইক্লেকটাস, আরু আইল্যান্ড ইক্লেকটাস ইত্যাদি রয়েছে। তবে ইউরোপ আমেরিকা সহ আমাদের দেশে গ্র্যান্ড ইক্লেকটাস, ভসমায়ের'স ইক্লেকটাস, নিউগিনি রেড সাইডেড ইক্লেকটাস, সলেমন আইল্যান্ড ইক্লেকটাস জনপ্রিয় বেশি ও আমদানিও হয় এই উপপ্রজাতিগুলো।
পোষা পাখি হিসেবে ইক্লেকটাসঃ
ইক্লেকটাস প্যারোট ততো বেশি একটা বিকট শব্দ করে না, মানুষের সঙ্গ অনেক পছন্দ করে। ইক্লেকটাস প্যারোট সুন্দর ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে, গান গাইতে পারে, ছড়া বলতে ও শব্দের অনুকরণ করতে ওস্তাদ। নানা কলা-কৌশল রপ্ত করতে পারে ও টেইম পাখি হিসেবে ইক্লেকটাস প্যারোট খুব ই চমৎকার একটি পাখি। ইক্লেকটাস প্যারোট কে প্রচুর খেলনা দিতে হবে, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম দোলনা, মই, নারিকেলের খোলসের তৈরি নানা রকম খেলনা দেয়া যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, খেলনা গুলো যেন নন-টক্সিন হয়ে থাকে। ইক্লেকটাস প্যারোট এর সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের প্রেম এ পরে ইক্লেকটাস প্যারোট কেনার আগে মনে রাখা উচিৎ এই পাখিটির সামাজিক ও মানসিক চাহিদা আছে, পাখির সাথে সময় কাটানোর ও তার প্রতি মনোযোগ দেয়ার সময় নিশ্চিত করে ই পাখি কেনা উচিৎ।
প্রজাতি # Grand eclectus, Vosmaer's eclectus, New Guinea red-sided eclectus parrot, Solomon Island eclectus parrot ইত্যাদি উপপ্রজাতি গুলো ই আমাদের দেশে বেশি আমদানি হয়।
© সাইফুল ইসলাম রিফাত