27/09/2017
ঁ কোয়েল পালন
**বিভিন্ন গৃহপালিত পাখির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রজাতি। গৃহপালিত ছোট আকারের খামারের জন্য কোয়েল পালনে তেমন কোন ঘরের প্রয়োজন নাই । কবুতরের মতো নির্দিষ্ট ঘর যেমন প্রয়োজন হয় না বা জোড়া বাঁদঅর জন্য।আবার মুরগির মতো খুব বড় আকারের খামারেরও প্রয়োজন নেই। যে বাজেটে কোয়েল পালন করা যেতে পারে। আজকাল ছোট বড় অনেক কোয়েল খামার গড়ে উঠেছে।
** মিশরীয়রা প্রখমে খাদ্য হিসেবে শুরু করলেও কোয়েলের আদি জন্মস্থান জাপানে। সবর্প্রথম জাপানী বিজ্ঞানীরা কোয়েলকে গৃহপালিত পাখি হিসেবে পোষ মানায়। পরবর্তীতে এশিয়অ সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোয়েলকে একটি লাভজনক পোলট্টি উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোয়েল পালন করার তেমন কোন খরচ হয় না। কোয়েলকে আতি সহজেই পোষ মানে।
***বাড়ির যেকোন কোণ স্থানে কানাচ বা উঠান অথবা পাকা বাড়ির ছাদ ইত্যাদি জায়গাতেও কোয়েল পালন করা যায়। এই কারণে বতর্মানে, শহরে কী গ্রামে সব স্থানে কোয়েল পালন ব্যাপকতর ও সহজ হয়েছে। গৃহপালিত পাখির মধ্যে এই পাখির আয়তন খুব বেশি নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ কোয়েলের ওজন ১৫০ থেকে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে।
***১টি মুরগি পালনের স্থানে মোটামুটিভাবে ৮-১০ টি কোয়েল পালন করা যায়।
*** এটা অতি সহজেই প্রমাণিত যে বাংলাদেশের আবহাওয়া কোয়েল পালনের জন্য সবর্ধিক উপযোগি। এই কারণে, বিভিন্ন হাঁস মুরগির খামারেও ইদানিং কোয়েল পালন বেশ সাড়া জাগিয়েছে। দেশের পুষ্টি মিটিয়ে ইদানিং কোয়েলের মাংস বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে।
*** কোয়েলের মাংস অতিথী পাখির মাংসের মতই স্বাদ ও মজাদার। কোয়েলের ডিমে পয়ার্প্ত পরিমাণ আমিষ, প্রোটিন ভিটামিন ও স্নেহজাতীয় পদার্থ বিদ্যমান। বিশেষ করে কোয়েলের একটি ক্ষুদ্র ডিমে যে পরিমাণ প্রেটিন রয়েছে একটি বড়ো আকারের মুরগির ডিমেও একই পরিমাণ প্রোটিন আছে । ভেবে দেখুন একটি মুরগির ডিমের দামে চারটি/পাঁচটি কোয়েলের ডিম পাওয়া যায়। এই কারণে, ধনী- গরীব সকল দেশের সকলে অবাদে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে।
*** আমাদের বাংলাদেশে কোয়েল পাখি এখনও প্রথম শ্রেণীর পল্টির তালকায় পরে তবে আশার কথা, আমাদের দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে ইদানিং কোয়েল পালনে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন অনেকেই।
ঢাকা শহরের বঙ্গবাজার এলাকার পোল্ট্রি মার্কেটে কোয়েলের ডিম, বাচ্চা এবং পরিণত কোয়েল বা প্যারেন্টস কোয়েল কিনতে পাওয়া যায়। এছারা কাপ্তান বাজার, টঙ্গি বাজার, কাটাবন মার্কেটে সহ বেশ কিছু জায়গায় কোয়েলের সামগ্রী ও কোয়েল পাওয়া যায়।
সরকারের সহায্য পেলে কোয়েলের খামার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন ও মাংস এবং ডিম বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা ও চমকপদ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
কোয়েলের জাত বা বংশ
বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন কোয়েলের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় জাপানি কোয়েলকে। আমাদের জানা মতে জাপানেরই কোয়েল পালনে সবর্প্রথম গৃহপালিত করা গৌরব অর্জিত হয়েছে।
কোয়েলের কয়েকটি জাত নিম্নরূপ-
ব্রয়লার কোয়েলঃ মুরগির মতো কোয়েলের মধ্যে ব্রয়লার জাতের কোয়েল আছে। এদের পালন করা হয় মাংসের জন্য্ । উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাংসের কোয়ের হল: এদের মাত্র ৪৫-৫০দিন পালন করা হয়। আমেরিকান বব হোয়াইট কোয়েল, হিন্দুস্থান স্বেত বা ইন্ডিয়ান হোয়াইট, ব্রেস্টেড কোয়েল ।
লেয়ার কোয়েলঃ মুরগির মতো কোয়েলের মধ্যেও লেয়ার জাত বিদ্যমান। এই জাতের কোয়েলকে শুধু ডিম উৎপাদন ও বংশ বিস্তারের জন্য পালন করা হয়।
লেয়ার জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বংস হলো: ফারাও, ইংলিশ হোয়াইট, ম্যানচিরিয়াল গোল্ডেন, ব্রিটিশ রেঞ্জ ।
একটি পূর্ণবয়স্ক কোয়েল সবার্ধিক ৪ বছর বেঁচে থাকে। একটি নারি কয়েল জীবনদশায় অন্ততপক্ষে ৭৫০ থেকে অনাধিক ১৩০০ ডিম প্রদান করে থাকে।
কোয়েলের ডিম:
ডিমের ওজন: থাকে ৯ শুধুমাত্র কিছু প্রজাতির কোয়েল সাদা রংয়ের ডিম পাড়ে। তাছাড়া বেশির ভাগ কোয়েলের ডিম বাদামী এবং গায়ে ফোঁটা ফোঁটা দাগ আছে। থেকে ১৫ গ্রাম। ডিমের ওজন স্ত্রী কোয়েলের দৈহিক ওজনের ৮%। ডিমের রং: কোয়েলের ডিম দেখতে খুব সুন্দর বাহারি ছিটেফোটা । ডিমের খোসার ওপর নীলচে, বেগুনীয়া, খয়েরি এবং কালো পাঁচমিশালী রঙ্গের ছোট ছোট ফোটা বা ছিটা ফোটা দাগ থাকে।
বংস বিস্তার: কোয়েলের প্রতিটি ডিমই হতে পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা আশা করা যায়। অর্থাৎ প্রতিটি ডিম থেকেই একটি বাচ্চা ফুটতে পারে। তবে বাচ্চা ফোটার জন্য ডিম তৈরি করতে হলে একটি পুরষ কোয়েলের সাথে তিনটি স্ত্রী কোয়েলকে কিছুদিন একসাথে রাখতে হবে। কোয়েলের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটর মেশিন ব্যবহার করা হয়। যাদের ইনকিউবেটরন নেই সেই ক্ষেত্রে আমরা দেশি ছোট মুরগির দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে থাকি। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১৭ থেকে ১৮ দিন সময় লাগে। তবে বাচ্চা ফোটার পরই সেগুলো পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে না। কারণ, কোয়েলের বাচ্চা খুবই সংবেদনশীল। এরা পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৪ দিন সময় নেয়। এই সময়টাতে বাচ্চার প্রতি অতিরিক্ত যত্নবান হওয়া একান্ত আবশ্যক। এইসময় বাচ্চাকে ব্রুডিং ঘরে নিয়ে যাওয়া ভাল। কারণ, সেই সময় কৃতিম উত্তাপ প্রয়োজন হয় বাচ্চার। ব্রুডিং পদ্ধতিতে বাচ্চার শরীর সেই সময় গরম করতে হয়।
কোয়েলের বাসস্থান
কোয়েলের বাসস্থান যাতে প্রয়োজন মতন আলো বাতাসের মধ্যে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখখতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে-বৃষ্টির পানি বা অন্য কোন তরলপদার্থ দ্বারা কোয়েলের খাঁচা ভিঁজে না যায়।
খাঁচায় কোয়েল পালন করা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। একটি খাঁচার ওপর আরেকটি খাঁচা এভাবে অল্প জায়গাতে অনেকগুলো খাঁচা তৈরী করে কোয়েল পালন করা যায়।
আদর্শঃমাপ
** ১৩০:৬০:৩০ সেমি: দৈর্ঘ্য: প্রস্থ:উচ্চতা বিশিষ্ট একটি খাঁচায় কমপক্ষে ৬০টি কোয়েল পালন করা যায়।
** ১৫০:১০০:৪৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য:প্রস্থ:উচ্চতা বিশিষ্ট একটি খাঁচায় কমপক্ষে ৯০টি কোয়েল পালন করা যায়।
** কোয়েলের খাচায় ব্যবহৃত জালের ফাকগুলো একটু ঘন হতে হবে। যাতে করে কোয়েলের মুখ বা গলা সেই ফাক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে না আসে।
** বাচ্চা রাখার খাঁচাসহ / বয়স্ক কোয়েলের খাঁচাগুলোতে যেন বেজি, কাঠবিড়ালী, ইদুর ইত্যাদি না প্রবেশ করতে না পারে, সেইভাবে খাঁচার শিকের ফাঁক বানাতে হবে।
*** কোয়েলের বাচ্চা পালনের সময় একটি অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। এই সময় বাচ্চাকে ব্রুডিং এর ব্যবস্থা করতে হয়। বাচ্চার বয়স ১৫ থেকে ২০ দিন কৃত্রিম উত্তাপের মাধ্যমে এই ব্রুডিং এর ব্যবস্থা করতে হয়। কারণ, ডিম থেকে ফোটার পর বাচ্চা উক্ত সময় স্পর্শকাতর এবং লালাভূলা থাকে। এই সময় বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় ক্যালোরিযুক্ত খাবারও দিতে হয়।
**সদ্যজাত বাচ্চা ক্যালোরির অভাবে শরীর ঠান্ডা হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারে।
সাধারণভাবে বাচ্চা ফুটলে সেগুলোকে আলাদা খাঁচায় স্থানান্তর করা উচিত। কারণ, তাহেল বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয় ব্রুডিং এর ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হয়ে থাকে। মুরগির বাচ্চার মতো একই পদ্ধতিতে কোয়েলের বাচ্চাকে ব্রুডিং বা কৃত্রিম তাপ প্রদান করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। বড়ো আকারের কোয়েলের খামারে বাচ্চা রাখার জন্য আলাদা ব্রুডার খাঁচা তৈরি করা হয়ে থাকে। যাতে করে বাচ্চা ডিম ফুটে বের হবার প্রায় সাথে সাথে সেই খাঁচায় বাচ্চা স্থানান্তর করা যায়।
মোটামুটিভাবে কোয়েল পালনের জন্য এই ধরণের বাড়তি যত্ন আর বাসস্থান প্রয়োজন হয়। তবে হিসেব করে দেখা গেছে ১০০০টি মুরগির জন্য যে ধরনের ব্যাপক বাসস্থানের প্রয়োজন হয়-সেই ধরনের জায়গায় কমপক্ষে ৮০০০ থেকে ১০০০০ কোয়েল পালন করা সম্ভবপর হয়ে থাকে।
কোয়েল পালনের সুবিধা সমূহ
কোয়েল পালনের বিভিন্ন সুবিধাসমূহ উল্লেখ করা হলো।
(১) সাধারণত একটি ভাল জাতের কোয়েল বছরে ২০০ থেকে ২৫০টি ডিম প্রদানে সক্ষম হয়ে থাকে। অনেক লেখক ৩০০ ডিমের কথা উল্লেক করে থাকেন। বাস্তবে তা সম্বভ নয় । তারা হুজুকে বাঙালী নেট থেকে পরে বাঙলা করে চালিয়ে দেয় কিন্তু আমাদের দেশে সম্বভ নয়। প্রায় প্রতিটি ডিম থেকেই বাচ্চা পাওয়া যায়। এই বাচ্চা ৪৫ দিনে বা ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যেই খাওয়া বা বিক্রির উপযোগী হয়। পাশাপাশি ডিম দেয়া শুরু করতে পারে।
(২) অত্যন্ত কম পুজি নিয়ে কোয়েলের খামার তৈরি করা যায়।
(৩) কোয়েল দিনে মাত্র ২০ থেকে ২৫ গ্রাম খাবার দিলেই এরা এদের শারীরিক চাহিদা মিটাতে পারে।
(৪) কোয়েলের আকার ক্ষুদ্র বলে এদের লালন পালনের জন্য বিস্তৃত জায়গা প্রয়োজন হয় না। ছোট আকারের একটি খাচাতেই কোয়েল পালন করা যায়। একটি মুরগির জন্য যে পরিমাণ জায়গা প্রয়োজন হয়। সেই একই জায়গা কমপক্ষে ৮টি কোয়েল পালন করা যায়।
(৫) খুবই অল্প সময়ের মধ্যে একটি বাচ্চা কোয়েল ডিম দিয়ে থাকে। সাধারণত ৪০-৪৫ দিনে এরা ডিম পাড়া শুরু করে। বা ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ বয়সেই একটি কোয়েল ডিম প্রদান করে থাকে।
(৬) রোগ ব্যাধির দিকে থেকে কোয়েল খুবই লাভজনক বিনিয়োগ। কারণ, কোয়েলের রোগ ব্যাধি প্রায় হয় না বললেই চলে। তিাই এদের কোন টিকা দরকার হয় না।
(৭) একটি পরিণত বয়সের কোয়েল বছরে ২০০- ২৫০টি ডিম প্রদান করতে পারে। সেই হিসেবে একটি কোয়েলের পেছনে যে ২ মাস থেকে লাভ আসতে শুরু করে। এত কম সময়ে অন্য কোন পাখি ডিম পারে না।
(৮) কোয়েলের ডিম থেকে ১৮/১৯ দিনের মধ্যেই বাচ্চা ফুটে বের হয়। এই বাচ্চা পরিণত কোয়েলে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে ৪০/৪৫ দিন বা ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ।
(৯) কোযেলের মাংসে ফেটের পরিমাণ খুব কম বলে যে কোন রোগীর পথ্য হিসেবে কোয়েলের মাংস ব্যবহৃত হতে পারে।
১০) এদের ডিম পুষ্টিকর। পুষ্টিমানের দিক থেকে মুরগির ডিমের সমমানের।