11/09/2021
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুরা রোগ বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- বাতা, ক্ষুরা, ক্ষুরপাকা, এঁসো, খুরুয়া, তাপরোগ, খুরাচল ইত্যাদি। দুই ক্ষুর ওয়ালা সকল প্রাণী এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া এ রোগের শিকার। ক্ষুরা রোগ হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। বছরের যেকোনো সময় এ রোগ হতে পারে। বর্ষার শেষ থেকে সারা শীতকাল (সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি) এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এ রোগে বাছুরের মৃত্যুর হার ব্যাপক এবং বয়স্ক পশুর উপর এর প্রভাব মারাত্মক। তবে এ রোগ দমন করা সম্ভব। একটু সচেতন থাকলে এবং সময়মতো প্রতিষেধক টিকা দিলে গবাদিপশুকে সহজেই এ রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
ক্ষুরা রোগ কি ?
ক্ষুরা রোগ অতি তীব্র প্রকৃতির সংক্রামক ভাইরাস জনিত রোগ| এ রোগে আক্রান্ত পশুর মুখ ও পায়ে ঘা হবার ফলে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না এবং খুঁড়িয়ে হাটে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এ রোগ দেখা যায়। তবে আমাদের দেশের গরুতে ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
রোগের কারণ : ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ নামক এক প্রকার ভাইরাস এ রোগ সৃষ্টি করে। সে কারণে ইংরেজিতে ক্ষুরা রোগকে এফ,এম,ডি বলে। এ ভাইরাসের মোট ৭টি টাইপ রয়েছে। এগুলোর নাম এ, ও, সি, স্যাট-১, স্যাট-২, স্যাট-৩ ও এশিয়া-১। বাংলাদেশে এবং এশিয়া-১ টাইপের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি।
রোগ বিস্তার : ক্ষুরা রোগ অত্যন্ত সংক্রামক হওয়ায় কোনো এলাকায় এ রোগ দেখা দিলে একশত ভাগ পশুই তাতে আক্রান্ত হয়। এ রোগের জীবাণু রোগাক্রান্ত প্রাণীর ফোসকা ফেটে অন্য প্রাণীর দেহে বিস্তার লাভ করে। রোগাক্রান্ত পশুর লালা, শেষ্মা, প্রস্রাব, মল ও দুধের মাধ্যমে দেহ হতে বের হয়ে আসে। এসব পশুর খাদ্য, পানি, আবাসস্থলের দেয়াল, বাতাস ইত্যাদি কলুষিত করে। বাতাসের সাহায্যে এ ভাইরাস ৬০/৭০ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। গ্রামাঞ্চলে অনেকে সময় আক্রান্ত পশুকে দূর-দূরান্তের হাটবাজারে বিক্রির জন্য নেয়া হয়। তখন ভাইরাস ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। আক্রান্ত পশুর পরিচর্যাকারীর চলাচল এবং তার জামাকাপড়, জুতা ইত্যাদির সাহায্যে ও ভাইরাস বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ভাইরাস বহনকারী ষাঁড় কৃত্রিম প্রজননের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক কারণ এ সব ষাঁড় থেকে সংগৃহীত সিমেন কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহার করলে এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে।
রোগের লক্ষণ : প্রথমে জ্বর হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা (১০৫-১০৭ ফারেনহাইট) এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, মুখের ভেতর এবং পায়ের ক্ষুরের মাঝে ফোসকা হয়, পরে ফোসকা ফেটে লাল ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
আক্রান্ত পশুর মুখ থেকে লালা পড়তে থাকে, ঠোঁটের নাড়াচড়ার ফলে সাদা ফেনা বের হতে থাকে এবং চপ চপ শব্দ হয়। ঘাষ বা অন্য কিছু খেতে পারে না বলে পশু দুর্বল হয়ে পড়ে।
ক্ষুরের ফোসকা ফেটে ঘা হয়, পা ফুলে ব্যথা হয়। ঘা বেশি হওয়ায় চলা ফেরা করতে কষ্ট হয়।
ক্ষত স্থানে মাছি ডিম পাড়ে ফলে পোকা হয়। মাছি ও জীবাণুতে ঘা বিষিয়ে উঠে। ফলে পশু পা ছুড়তে থাকে যেন পায়ে কিছু লেগে আছে।
রোগের পরিমাণ বেশি হলে ক্ষুরা বা জিহ্বা খসে পড়তে পারে। গাভীর ওলানে ফোসকা হতে পারে, ফলে ওলান ফুলে উঠে এবং দুধ কমে যায়। বাছুরের এ রোগ হলে বাছুর প্রায়ই মারা যায়।
পশুর শ্বাসকষ্ট, রক্ত শূন্যতা এবং পরিবেশগত উচ্চ তাপমাত্রায় অসহিষ্ণুতা দেখা যায়।
ক্ষতিকর প্রভাব : ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক হওয়ায় প্রতি বছর অসংখ্য পশু এ রোগে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে বিশেষ করে বাছুর বেশির ভাগই মারা যায়।
রোগাক্রান্ত পশু সুস্থ হলেও কৃষি কাজে ব্যবহার করা যায় না ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। দুধ ও মাংসের উৎপাদন হ্রাস পায়।
গর্ভবতী গাভীর গর্ভপাত হয় এবং বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। ওলানের প্রদাহ হলে গাভীর দুধ দেয়ার ক্ষমতা চিরতরে লোপ পায়।
প্রতিকার : পৃথিবীর অনেক দেশ ক্ষুরা রোগ মুক্ত। এসব দেশের মধ্যে ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। এসব দেশে হঠাৎ কোনো স্থানে ক্ষুরা রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত পশুকে মেরে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়। আমাদের দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক বলে অনুরূপ পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে পরিষ্কার শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই কাদা বা পানিতে রাখা যাবে না।
এ রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে। তাই আক্রান্ত পশুকে অন্যত্র নেয়া এবং বাইরের কোনো পশুকে এ এলাকায় আনা উচিৎ নয়।
আক্রান্ত এলাকার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল সুস্থ পশুকে অবিলম্বে টিকা দিতে হবে।
আক্রান্ত পশুকে নরম ও তরল খাবার যেমন- ভাতের ফ্যান বা জাউভাত খেতে দিতে হবে।
যিনি আক্রান্ত পশুর সেবাযত্ন করবেন তার ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়, হাত-পা এবং ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিস অবশ্যই জীবাণু নাশক ওষুধ দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এ জন্য ১ লিঃ পানিতে ৪ চা চামচ আইওসান মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করাতে হবে।
মৃত পশুকে মাটির নিচে পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
পশুর ঘর সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। দৈনিক ২% আইওসান দ্রবণ দিয়ে বা অন্য কোনো সুবিধাজনক জীবাণুনাশক দ্রব্য মিশ্রিত পানি দ্বারা ধুয়ে দিতে হবে।
সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কারণ এ ব্যবস্থা ছাড়াই সীমান্তবর্তী দেশ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য গরু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করায় এদেশে এ রোগ প্রতিরোধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
ক্ষুরা রোগ চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাই বেশি কার্যকর, তাই ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধের জন্য কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা জোরদারকরণসহ গবাদিপশুকে প্রতি ৬ মাস অন্তর এ রোগের টিকা দিয়ে নিতে হবে। তাহলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে আমাদের দেশের গবাদিপশুকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।