15/06/2024
কোরবানির জন্য সুস্থ পশু চেনার উপায় এবং আগে-পরে করণীয়
ডা: মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
কোরবানির জন্য সুস্থ পশু চেনার উপায়
১. পশু কেনার জন্য তাড়াহুড়ো না করে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে হাটে যেতে হবে।
২. সুস্থ পশুর স্বাভাবিক চাঞ্চল্য থাকবে এবং মাঝে মাঝে জাবর কাটবে। অন্যদিকে অসুস্থ পশু ক্লান্ত থাকবে এবং ঝিমাবে।
৩. সুস্থ পশু সচেতন থাকবে এবং কোথাও কোন শব্দ হলে সেদিকে লক্ষ্য করবে।
৪. সুস্থ পশুর নাকে বিন্দুবৎ ঘাম থাকবে, নাকের উপরের কালো অংশ ভেজা ভেজা এবং চকচকে হবে। অন্যদিকে অসুস্থ পশুর নাক থাকবে শুকনা।
৫. সুস্থ পশুর গতিবিধি চটপটে থাকবে এবং কান ও লেজ দিয়ে মশামাছি তাড়াবে।
৬. সুস্থ পশুর সামনে খাবার ধরলে পশু নিজ থেকে জিহ্বা দিয়ে টেনে খাবে।
৭. সুস্থ পশুর শরীরের চামড়া টানটান, পশম মসৃণ ও উজ্জ্বল হবে। চামড়া টান দিয়ে ছেড়ে দিলে দ্রুত পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।
৮. স্টেরয়েড বা ওষুধ দিয়ে মোটাতাজা করা পশুর মাংসপেশি থেকে শুরু করে শরীরের অন্য অঙ্গগুলো অস্বাভাবিক ফোলা থাকবে। শরীরে পানি জমায় বিভিন্ন অংশে চাপ দিলে সেখানে গর্ত হয়ে দেবে যাবে এবং পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেবে।
৯. সুস্থ পশুর শরীরের তাপমাত্রা থাকবে স্বাভাবিক। অসুস্থ পশুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হবে।
১০. সুস্থ পশুর শ্বাসপ্রশ^াস স্বাভাবিক থাকবে এবং অযথা ছটফট করবে না।
১১. অনেকক্ষণ খেয়াল করলে সুস্থ পশুকে পায়খানা ও/অথবা প্রস্রাব করতে দেখা যাবে, গোবর স্বাভাবিক (পাতলা নয়) ও প্রস্রাব থাকবে পরিষ্কার।
১২. চলাফেরা স্বাভাবিক কিনা তার জন্য পশুকে হাঁটিয়ে দেখতে হবে।
১৩. গর্ভবতী পশু কোরবানি দেওয়া যায় না। তাই কেনার আগে সেটা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
১৪. অন্ধ, পঙ্গু, দাঁতহীন পশু কোরবানির অযোগ্য বলে গণ্য হবে।
১৫. কোরবানির জন্য গরুর বয়স দুই বছর বা তার অধিক, ছাগল বা ভেড়ার বয়স এক বছর বা তার অধিক এবং উটের বয়স পাঁচ বছর বা তার অধিক হতে হবে।
পশু ক্রয়ের পর করণীয়
১. সুস্থ পশু ক্রয়ের পরে তাকে যতটা সম্ভব কম হাঁটিয়ে/গাড়িতে করে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।
২. বাড়ি নিয়ে প্রথমেই পশুকে পটাশ (পিপিএম) পানি দিয়ে গোসল করানো ভালো।
৩. পশুহাট ফেরত সকলেই হাত-পা সাবান দিয়ে ধৌত করতে হবে, সম্ভব হলে গোসল করতে হবে।
৪. প্রথমে পশুকে ৩-৫ লিটার যথাযথভাবে মেশানো স্যালাইন পানি পান করাতে হবে।
৫. পেটফাঁপা বা বদহজম থাকলে ১ কেজি পানিতে ১০০ গ্রাম খাবার সোডা মিশিয়ে খাইয়ে দিতে হবে।
৬. এরপরে কিছু কাঁচা ঘাস/শুকনো খড় দিতে হবে, ঘণ্টা খানেক পরে দানাদার খাদ্য যেমন-কুঁড়া, ভুসি, খৈল প্রভৃতি খেতে দেওয়া যাবে।
কোরবানির আগের দিন পর্যন্ত করণীয়
১. পশুর থাকার জায়গা, দাঁড়ানোর ও শোবার জন্য উপযুক্ত হতে হবে নতুবা তার মাংসের গুণগত মান হ্রাস পাবে।
২. প্রতিদিন কোরবানি পশুকে একই সময়ে গোসল করাতে হবে।
৩. সকালে ও রাতে পশুকে খড়/ঘাস (দানাদার খাদ্য নয়) খেতে দিতে হবে।
৪. দিনে কেবল দুইবার দানাদার খাদ্য দিতে হবে, তার মোট পরিমাণ পশুর শারীরিক ওজনের ১% এর বেশি হবে না।
৫. পশুর সামনে সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিশ্চিত করতে হবে।
৬. সারাদিন পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস ও খড় খেতে দিতে হবে।
৭. কোরবানির ১২ ঘণ্টা পূর্ব হতে দানাদার খাদ্য বন্ধ করে শুধু খড় ও পানি খেতে দিতে হবে।
কোরবানির সময় করণীয়
১. কোরবানির সকালে কেবল খাবার সোডা মিশ্রিত পানি পান করানো যাবে, অন্য কিছু নয়।
২. যত্রতত্র জবাই না করে যথাসম্ভব নির্ধারিত জায়গায় সকলে জবাই করতে হবে। একাধিক অপশন থাকলে জায়গা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ইত্যাদি বিবেচনাপূর্বক একটি সার্বজনীন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
৩. জবাইয়ের পূর্বে নির্ধারিত স্থানে গর্ত খুঁড়ে রাখতে হবে।
৪. পশুকে ভালোভাবে বাঁধার জন্য পর্যাপ্ত পাটের নতুন/পরিষ্কার দড়ি আগে থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
৫. জবাইয়ের সময় পশু যাতে কম কষ্ট পায় সেদিকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য রাখতে হবে।
৬. জবাইয়ের জন্য বাঁধার পূর্বে পশুর গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে, হৈহুল্লোড় এড়িয়ে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য, যেকোন ধকল, ভীতি বা অপ্রয়োজনীয় ভোগান্তি পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা যা মাংসের গুণগত মান হ্রাস করবে।
৭. অবশ্যই অবশ্যই পর্যাপ্ত ধারালো ছুরি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৮. শিশু, অতিবৃদ্ধ বা মানসিকভাবে সবল নয় এমন লোকজনকে জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করতে হবে।
হালাল জবাইয়ের প্রক্রিয়া
১. কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী স্বাস্থ্যবান, হৃষ্টপুষ্ট ও তৃষ্ণা নিবৃত প্রাণী জবাই করতে হবে।
২. জবাই পূর্ব সময়ে প্রাণীকে ন্যূনতম ৬ ঘণ্টা অভুক্ত রাখতে হবে (শুধুমাত্র পানি পান করানো যাবে), তবে অন্য কোনভাবে কষ্ট দেয়া ও অচেতন করা নিষিদ্ধ।
৩. পরিষ্কার স্থানে শুইয়ে, ধারালো ও পরিষ্কার ছুরি দ্বারা অভিজ্ঞ মুসলিম দ্বারা জবাই করতে হবে।
৪. প্রাণীর মাথা কেবলামুখী করে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হবে।
৫. স্পাইনাল কর্ড বা ঘাড়ের হাড় বিচ্ছিন্ন না করে প্রাণীর শ^াসনালী, খাদ্যনালী, মূল ধমনী ও শিরা সম্পূর্ণভাবে কাটতে হবে।
৬. জবাইয়ের পর দেহের সম্পূর্ণ রক্ত প্রবাহ করতে হবে।
জবাইয়ের পর মাংস তৈরির হালাল পদ্ধতি
১ম ধাপ: খাদ্যনালী গিঁট দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন খাদ্যের উচ্ছিষ্ট মাংসের সংস্পর্শে না আসে
২য় ধাপ: রক্তের স্বাভাবিক নিঃসরণ সম্পূর্ণ করে পা ও মাথা পরিষ্কার করতে হবে
৩য় ধাপ: প্রাণীর দেহের চামড়া যথাযথভাবে অক্ষত রেখে অপসারণ করতে হবে ও ষাঁড়ের যৌনাংগ অপসারণ করতে হবে
৪র্থ ধাপ: লেজ অপসারণ করে পায়ুপথ কেটে বেঁধে ফেলতে হবে যেন মাংস কোনভাবেই মল-মূত্রের সংস্পর্শে না আসে
৫ম ধাপ: সতর্কভাবে বুক ও পেট চিড়তে হবে যেন পাকস্থলীর উচ্ছিষ্ট মাংসের সংস্পর্শে না আসে
৬ষ্ঠ ধাপ: শরীরের ভেতরের অংগসমূহ (কলিজা, ভূড়ি ইত্যাদি) বের করতে হবে এবং খাদ্যনালী পরিষ্কার করতে হবে
৭ম ধাপ: লেজের মূল হতে মেরুদন্ডের মাঝ বরাবর লম্বালম্বি করে দু’ভাগ এবং প্রতি আধাভাগের ৫ম ও ৬ষ্ঠ অথবা ১২তম ও ১৩তম পাজরের হাড়দ্বয়ের মাঝ বরাবর আড়াআড়ি করে চার খ- করতে হবে
৮ম ধাপ: পরিষ্কার জায়গায় পরবর্তী মাংস তৈরির কাজ করতে হবে।
পশুর চামড়া ছাড়ানো বিষয়ে করণীয়
১. ভালো চামড়া পেতে পশু জবাই করার পূর্বে ভালোভাবে গোসল করাতে হবে এবং প্রচুর পানি খাওয়াতে হবে।
২. ধারালো ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে জবেহ করার স্থান থেকে গলা, সিনা ও পেটের উপর দিয়ে সোজাসুজি দাগ কাটতে হবে।
৩. সামনের দুই পায়ের হাঁটু থেকে সিনা পর্যন্ত একটি দাগ কেটে প্রথম দাগের সাথে যোগ করতে হবে এবং অনুরূপভাবে পেছনের দুই পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে দাগ কেটে প্রথম দাগ পর্যন্ত কাটতে হবে।
৪. সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে চামড়া ছাড়িয়ে, তাতে দ্রুত পরিমাণমতো (প্রতি কেজিতে ২০০ গ্রাম) লবণ ছড়িয়ে দিতে হবে।
৫. ছাড়াইকৃত চামড়া যথাশীঘ্রই বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কোরবানির পর মাংস সংরক্ষণে করণীয়
৬. ফ্রিজারে সংরক্ষণের প্রয়োজন হলে কাটার পরপর মাংস স্তূপ না করে যথাসম্ভব ছড়িয়ে ঠা-া হতে দিতে হবে, দ্রুততার সাথে ছোট ছোট প্যাকেট ফ্রিজে রেখে কয়েক ঘণ্টা পরপর ওলটপালট করে সমভাবে শীতলীকরণ নিশ্চিত করতে হবে; অন্যথায় মাঝখানে রাখা মাংস নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
৭. ফ্রোজেন মাংস কোন কারণে একবার গলানো হলে/গলে গেলে দ্বিতীয়বার ফ্রিজিং করা যাবে না, এতে মাংস নষ্ট হয়ে যাবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করণীয়
১. সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই করতে হবে।
২. রক্ত, মলমূত্র ও বর্জ্য একত্রে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
৩. পশু জবাইয়ের স্থান ডিটারজেন্ট ও ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে ভালো করে ধৌত করতে হবে এবং আশেপাশে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে।
৪. পশু জবাই করার পর রক্ত যাতে চারদিকে ছড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি না করে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৫. সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য ফেলতে হবে।
সূত্র: কৃষি ও তথ্য সার্ভিস, বাংলাদেশ সরকার