08/02/2021
'মুয়েজ্জা' নামে রাসূল ﷺ এর এক আদরের বিড়াল ছিলো। তিনি একে ওহুদের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় পেয়ে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। এটি ছিলো সাদা-কালো রংয়ের একটি আবিসিনিয়ান বেড়াল। সে হিসেবে, বেড়াল পালন করা সুন্নাহ।
একদিন তাঁর পবিত্র পরিচ্ছদের একাংশে মুয়েজ্জা পরম আরামে ঘুমিয়েছিলো। এদিকে নামাজের ওয়াক্ত প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। তবু মুহাম্মদ ﷺ তাকে টেনে তোলেননি, পোশাক ঝাড়া দেননি, দূর দূর করে তাড়িয়েও দেননি। এমনকি ঘুম ভেঙে যেতে পারে ভেবে, পাছে বিড়ালটির কষ্ট হয় — তাই গায়ে হাত বুলিয়ে ডাকও দেননি। তিনি যা করেছেন, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা — বাস্তবে করাতো অনেক দূরের ব্যাপার..
মুহাম্মদ ﷺ আলতো করে ঘুমন্ত বিড়ালটার সমপরিমাণ জায়গা রেখে — বাকি কাপড়টুকু প্রায় নিঃশব্দে কেটে ফেলেছিলেন। এরপর ছেঁড়া পোশাকটি গায়ে চড়িয়ে দিব্যি নামাজে রওনা দিলেন।
আমাদের নবী (সাঃ) একবার এক বেড়ালের পান করা ঝুটা পানি দিয়ে ওজু করে নামাজ পড়েছিলেন। শুধু তাই নয়, মুয়েজ্জার পান করা পানির অবশিষ্ঠ অংশ আমাদের নবী (সাঃ) ও পান করেছিলেন বলে এক হাদিসে এসেছে। আমরা অনেকেই বেড়াল অনেক ভালোবাসি, কিন্তু বেড়ালের পান করা পানির অংশবিশেষ আমরা খেতে পারবো? অনেকেই পারবে না, কিন্তু রাসূল (সাঃ) পান করেছিলেন!
আমাদের মা আয়েশা (রাঃ) বেড়ালের খাওয়া খাবার থেকে নিজেও খেয়েছিলেন। দাউদ ইবনু সা-লিহ ইবনু দীনার (রহঃ) থেকে তার মাতার সূত্রে বর্ণিত। তার (মায়ের) মুক্তিদানকারিণী মুনীব একবার তার মাকে এক বাটি পায়েস নিয়ে ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর নিকট পাঠালেন। তার মা বলেন, আমি গিয়ে তাঁকে সালাতরত পেলাম। তিনি তখন আমাকে (হাত দিয়ে) ইশারা করলেন, ‘তা রেখে দাও’। তখন একটি বিড়াল এলো এবং তা হতে কিছু খেল। এরপর ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) সালাত শেষ করে বিড়ালের খাওয়া স্থান থেকেই খেলেন এবং বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিড়াল নাপাক নয়। ওটা তোমাদের আশেপাশে ঘন ঘন বিচরণকারী জীব। তিনি [‘আয়িশাহ্ (রাঃ)] আরো বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিড়ালের উচ্ছিষ্ট (পানি) দিয়ে উযূ করতে দেখেছি। (আবূ দাঊদ)।
বিখ্যাত সাহাবী, হাদিসের বই খুল্লেই যাঁর নাম আসে, সেই আবু হুরায়রা (রাঃ) বেড়াল এতটাই ভালবাসতেন যে তার নামই হয়ে গেলো বেড়ালের পিতা। নবী (সাঃ) তাঁর এই নাম দিয়েছিলেন। [সেই হিসাবে আমিও একজন আবু হুরাইরা।] উনি বেড়ালের বাচ্চা অত্যন্ত ভালবাসতেন, এবং যেখানে যেতেন সাথে করে নিয়ে যেতেন। অর্থাৎ, উনার সাথে প্রায় সব সময়ই বেড়াল থাকতো।
একাধিক হাদিসে এসেছে, বেড়াল পবিত্র প্রাণী; পাক প্রাণী। নাপাক নয়। ইসলামে বেড়াল পালনকে যত ভাবে সমর্থন করা হয়েছে, আর কোন পোষা প্রাণীকে এতটা করা হয়নি। বেড়াল পালনকে উৎসাহ দিয়ে প্রচুর হাদিস ও মাসাআলা রয়েছে। হাদিসে আছে, "Affection for cats is part of faith" (Maqasid al-Hasanah, al-Sakhawi)। অর্থাৎ, বেড়ালের প্রতি ভালোবাসা থাকা হচ্ছে ঈমানের অংশ।
বিড়ালের মাংস খাওয়া হারাম হওয়ার কারণে এর ঝুটাও হারাম হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু একটা হাদিসের কারণে ইসলামি চিন্তাবিদগণ এর ঝুটাকে হারাম থেকে নামিয়ে মাকরুহ সাব্যস্ত করেছেন। হাদিসটি হলো, হজরত কাবশা বিনতে কাব ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হজরত আবু কাতাদা (রা.) আমার নিকট আগমন করলেন। আমি তার জন্য পানিভর্তি একটি উজুর পাত্র উপস্থিত করলাম। এমন সময় একটা বিড়াল তা হতে পান করল। তিনি ঐ বিড়ালটির জন্য পাত্রটি কাত করে দিলেন, যাতে সে নির্বিঘ্নে পান করতে পারে।
কাবশা (রা.) বলেন, তখন আবু কাতাদা (রা.) দেখলেন, আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। তিনি বললেন, ‘হে ভাতিজী! তুমি কি আশ্চর্য বোধ করছ? আমি বলাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এরা (বিড়াল) অপবিত্র নয়, এরা তোমাদের আশেপাশে বিচরণকারী এবং বিচরণকারিনী।’ (সুনানে নাসাই: ৩৪১)
তাই কোনো খাবারে যদি বিড়াল মুখ দেয় আর খাবারের মালিক ধনী হয় তাহলে ওই খাবার খাওয়া তার জন্যে মাকরুহ বা অপছন্দনীয়। আর খাবারের মালিক যদি দরিদ্র হয় তাহলে তার জন্যে খাবারটি খাওয়া জায়েজ। (ফতওয়ায়ে আলমগিরি: ৪৩: ১)
বেড়ালের প্রসাব কাপড়ে লাগলেও সে কাপড়ে নামাজ হবে, তবে সুযোগ থাকলে তা পরিস্কার করে নামাজ পড়াই উত্তম। কিন্তু কুকুরের প্রসাব গায়ে লাগলে কাপড় কমপক্ষে ৭ বার ধৌত না করলে নামাজই হবে না। (হানাফী মাদহাব অনুযায়ী)
যেহেতু ইসলামে বেড়াল পালন করা সুন্নাহ, সেহেতু এটিকে কোন রূপ কষ্ট দেয়া বা বেড়ালের সাথে অন্যায্য আচরণ করা ইসলামে কবিরা গুনাহ। জনৈক মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে আযাব দেওয়া হয় ও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়। কারণ সে বিড়ালটিকে বন্দি করে রাখে, এ অবস্থায় সেটি মারা যায়। সে এটিকে বন্দি করে রেখে পানাহার করায়নি এবং তাকে ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে (নিজে) জমিনের পোকা-মাকড় খেতে পারে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৮২
বেড়াল ও কুকুর কেনা-বেচা করা সম্পূর্ণরূমে হারাম। কুকুর-বেড়ালকে এডাপশানে দেয়া ও নেয়া যাবে, কিন্তু সেটার বিনিময়ে কোন প্রকার আর্থিন লেনদেন করা যাবে না।
মক্কা সহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ মসজিদে বিড়ালের অবাধ অনুপ্রবেশ। এরা প্রত্যেক ইবাদতকারীর পাশেই ঘুমায়, গা ঘেঁষে বসে থাকে যেখানে সেখানে। মানুষের আদর ভালোবাসায় লাই দিয়ে গড়া অদ্ভুত এই বিলাসপ্রবণ প্রাণী! পরিস্কার পরিছন্ন ও পাক-পবিত্র থাকার কারণে পৃথিবীর সমস্ত মসজিদে বেড়ালের অবাধ প্রবেশ অনুমোদিত।
অষ্ট্রেলিয়ার অনেক মসজিদে দেখেছি, নামাজরত অবস্থাতেও মুসল্লীদের সামনে দিয়ে অবাধে বেড়াল যাতায়াত করছে। কারণ রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ”বিড়াল সলাত বিনষ্ট করে না। (মানে নামাজের সময় সামনে দিয়ে যাতায়াত করলেও নামাজের কোন ক্ষতি হবে না।) কারণ তা ঘরের উপকারী জিনিসপত্রের অন্তর্ভুক্ত।” (সুনানু নাসাঈঃ ৩৬৮)।
মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য মসজিদ বেড়ালের আস্তানা। বেড়াল ও মুসল্লীদের চমৎকার সহাবস্থান। আমি জানি না ঢাকায় এমন কোন মসজিদ আছে কিনা।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ”কিতাত মসজিদ” নামে একটা মসজিদ আছে, যেটা বেওয়ারিশ বেড়ালদের রক্ষনাবেক্ষনের জন্য প্রতিস্ঠিত হয়েছিলো। সে মসজিদে শত শত বেড়াল বসবাস করে। মসজিদের অনুদান থেকে বেড়ালদের জন্য খাবার-দাবার ও পথ্য কেনা হয়।
তুরস্কের ইস্তামবুলে বায়েজিদ লাইব্রেরি নামে একটা বিখ্যাত লাইব্রেরি আছে। ঐ লাইব্রেরীর প্রাক্তন ডিরেক্টর İsmail Saib Sencer শত শত বেড়াল পালতেন। লাইব্রেরীর ভেতরেই তার বেড়ালগুলো বসবাস করতো। এই কারণে স্থানীয়ভাবে সেটি বেড়ালের লাইব্রেরী নামেও পরিচিত।
সংগ্রহীত