02/01/2024
"ভেটেরিনারি সায়েন্স বনাম পশুপালনঃ প্রাণিসম্পদ বিভাগের পশ্চাৎযাত্রা"
ডাঃ মোঃ আবু বকর আহাদ
ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঘোড়া ও ষাঁড়ের উৎকর্ষতায় আগ্রহ দেখায় এবং ১৭৭৪ সালে ভারতে ঘোড়ার প্রজনন খামার স্থাপন করে। তখন থেকেই উপমহাদেশে আধুনিক প্রাণি চিকিৎসাবিজ্ঞানের সূচনা হয় এবং ভেটেরিনারি পেশার ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। শুরুর দিকে প্রজনন খামারগুলোর উন্নয়নের জন্য লন্ডন ভেটেরিনারি কলেজ থেকে পাশ করা দক্ষ ভেটেরিনারিয়ানরা ভারতে আসতে থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রথিতযশা ব্রিটিশ ভেটেরিনারিয়ান William Moorcroft -কে ঘোড়ার প্রজনন খামারের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর খামারের ক্ষতি ৯০ শতাংশ হ্রাস পায়। ১৮৬২ সালে পুনেতে “আর্মি ভেটেরিনারি স্কুল” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিক ভেটেরিনারি শিক্ষার শুরু হয়। এর পনেরো বছর পর ১৮৭৭ সালে প্রথম “সিভিল ভেটেরিনারি স্কুল” প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তর প্রদেশের বাবুগড়ে। গবাদি প্রাণীর রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রজনন ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৮৮১ সালে ভারতে সিভিল ডিপার্টমেন্টের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৮২ সালে পাকিস্তানের লাহোরে প্রথম ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৮ সালে রয়্যাল কমিশন অন এগ্রিকালচার ভারতীয় উপমহাদেশে সহকারী ভেটেরিনারি সার্জনের সংখ্যা ৪ গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করে এবং একই সাথে মানসম্মত ভেটেরিনারি ডিগ্রী দেওয়ার লক্ষ্যে বিদ্যমান ভেটেরিনারি কলেজগুলো উন্নত করার পরামর্শ দেয়। পরামর্শ মোতাবেক মাদ্রাজ ভেটেরিনারি কলেজ এই লক্ষ্যে নেতৃত্ব দেয় এবং ১৯৩৬ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে “ব্যাচেলর অব ভেটেরিনারি সায়েন্স” ডিগ্রী প্রদান শুরু হয়। ঐ সময়ে অবিভক্ত বাংলায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিলো প্রাণিসম্পদ সেক্টর।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর বেশিরভাগ মুসলিম ভেটেরিনারি সার্জন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। ঐ বছরের ৭ ডিসেম্বর কুমিল্লায় “ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজ” প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে ৩ বছয় মেয়াদী “ডিপ্লোমা ইন ভেটেরিনারি মেডিসিন এন্ড সার্জারি (ডিভিএমএস)” ডিগ্রি দেয়া হতো যা পরবর্তীতে “লাইসেন্সিয়েট ভেটেরিনারি সায়েন্স (এলভিএস)” হিসেবে নামকরণ করা হয়। এসময় কৃষি ও প্রাণিসম্পদ সেক্টর দুটোকে আলাদা করা হয়। ১৯৫১ সালে কুমিল্লা থেকে “ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজ” ঢাকার তেজগাঁওয়ে স্থানান্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজের নামকরণ করা হয় “ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সাইন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি” যেখান থেকে ৫ বছর মেয়াদী “বিএসসি ইন এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” ডিগ্রি দেয়া হতো (মূলত ভেটেরিনারি সায়েন্স এবং এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি কে অবিচ্ছেদ্য বিবেচনায় এ ধরণের নামকরণ করা হয়)। ১৯৫৭ সালে “ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সাইন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি” তেজগাঁও, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে স্থানান্তরিত হয় এবং “বিএসসি ইন এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” ডিগ্রীর নাম পরিবর্তন করে “বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স এন্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” রাখা হয় যা ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
পূর্ব বাংলার জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশক্রমে ১৯৬১ সালে “ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সাইন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি” কে কেন্দ্র করে “ইস্ট পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়” (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৯৬২ সালে একই কমিশনের সুপারিশে ইস্ট পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে “বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স এন্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” ডিগ্রীকে বিলুপ্ত করে ভেটেরিনারি ও পশুপালন নামক দুটি পৃথক অনুষদ তৈরি করা হয়। ভেটেরিনারি অনুষদে “ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম)” এবং পশুপালন অনুষদে “বিএসসি ইন এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” ডিগ্রী প্রবর্তন করে পেশাগত বিভাজনের বীজ বপন করা হয়। উল্লেখ্য, যৌথ ইন্দো-আমেরিকান ও পাক-আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা ভারতবর্ষের কৃষি শিক্ষা ও গবেষণায় আমেরিকার এ সুপারিশে “বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স এন্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” ডিগ্রীকে দুটি পৃথক ডিগ্রীতে বিভক্ত করার সুপারিশ করে। ভারতের ২২টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩টি এবং পাকিস্তানের ২টি বিশ্ববিদ্যালয় দুটো ডিগ্রীকে আপাতত আলাদা করে দিলেও পরবর্তী সময়ে ভারতের ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল কমিশন এ দুই ডিগ্রীর বিভক্তি প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে আবারও সমন্বিত ডিগ্রী চালু করে। কিন্তু বাংলাদেশে এই হুমকি সনাক্ত ও ব্যবস্থা নিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ফলে দুই ডিগ্রিধারীদের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।
কৌশলগতভাবে দ্বন্ধ নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ভেটেরিনারি মেডিসিন ও পশুপালন উভয় ডিগ্রীকে পুণরায় একীভূত করে “কম্বাইন্ড ডিভিএম” ডিগ্রী চালু করার উদ্যোগ নেয়। যার প্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ এবং ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় যেগুলো পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। “কম্বাইন্ড ডিভিএম” ডিগ্রী পরবর্তীতে আরও অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া শুরু হয় এবং এই ডিগ্রীধারীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে পশুপালন ডিগ্রীধারীরাও তাদের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে শত বিরোধিতা স্বত্ত্বেও ২০১০ সালে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশুপালন অনুষদ খুলে পশুপালন ডিগ্রী প্রদান শুরু করে। পশুপালন ডিগ্রিধারীরা কম্বাইন্ড ডিভিএম ডিগ্রীর অন্তর্গত পশুপালন বিষয়ের স্বীকৃতি দিতে নারাজ যদিও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক পশুপালন ডিগ্রিধারী। এজন্য পরবর্তীতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুনভাবে ভেটেরিনারি সায়েন্স পড়ানো হচ্ছে সেখানে “কম্বাইন্ড ডিভিএম” ডিগ্রীর নাম পুণরায় “বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স এন্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” করা হয়েছে। ভেটেরিনারিয়ানরা “ডিভিএম” অথবা “বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স এন্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” ডিগ্রীর সাথে “বিএসসি ইন এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” ডিগ্রী একীভূত করার ব্যাপারে সম্মতি দিলেও পশুপালন ডিগ্রীধারীরা স্বকীয়তা ধরে রাখতে বরাবরের মতই অনাগ্রহ প্রকাশ করে আসছে।
অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কা থেকে পশুপালন ডিগ্রিধারীরা এখন নতুন অপকৌশল অবলম্বন করেছে। তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব ড. নাহিদ রশীদ (তিনি একজন পশুপালন ডিগ্রিধারী) -এর নেতৃত্বে পশুপালন ডিগ্রীধারীরা স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ এবং যাচাই বাছাই ছাড়া গোপনীয়তার সাথে “বাংলাদেশ এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন” তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। এই আইনের মাধ্যমে গোষ্ঠীগত স্বার্থ বিবেচনায় পশুপালন ডিগ্রিধারীরা ন্যক্কারজনকভাবে ভেটেরিনারি পেশাজীবীদের অনেক প্রতিষ্ঠিত অধিকার খর্ব করে তা নিজেদের বলে দাবি ও প্রচারণা করছেন। তারা দাবি করছেনঃ প্রাণি উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, প্রানি পুষ্টি, প্রানি প্রজনন, প্রানিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্য নিরাপত্তা ইত্যাদি তাদের কাজ; আর ভেটেরিনারিয়ানদের কাজ শুধুমাত্র চিকিৎসা করা! অথচ বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী প্রাণিজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং স্থানীয় অথবা আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাতকরণের প্রতিটি স্তরে ইন্সপেকশন ও সার্টিফিকেশনের দায়িত্বে থাকবে শুধুমাত্র ভেটেরিনারিয়ান। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থার সুস্পষ্ট নির্দেশনায় বলা আছে যেঃ ভেটেরিনারিয়ানরা প্রাণি কল্যাণ সমুন্নত রেখে প্রাণি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা, প্রাণির রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ, প্রজনন ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম প্রজনন, খাদ্য নিরাপত্তা, গণস্বাস্থ্য, জুনোসিস ও মহামারী নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ ও টিকা উৎপাদন, প্রাণিজাত পণ্য বাজারজাতকরণ, আমদানি ও রপ্তানিতে সার্টিফিকেশন, প্রজাতি সংরক্ষণ, স্থল ও জলস্থ্ বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত থাকবেন।
ভেটেরিনারি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম এমনভাবে সাজানো যাতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর একজন ভেটেরিনারি জেনারেলিস্ট জল, স্থল কিংবা আকাশচরী, গৃহপালিত থেকে বন্য, ভক্ষণযোগ্য কিংবা সহচর এই বিশাল প্রাণী জগতের কল্যাণে কাজ করতে পারেন। এরপর সুনির্দিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করে ভেটেরিনারি স্পেশালিস্টগণ মেডিসিন, সার্জারি, থেরিওজেনোলজি, কার্ডিওলজি, ডেন্টিস্ট্রি, ডার্মাটোলজি, অপথালমোলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, এনেস্থেসিয়া, ইমার্জেন্সি এন্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার, নিউট্রিশন, স্পোর্টস মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন, ফার্মাকোলজি, টক্সিকোলজি, রেডিওলজি, প্রিভেন্টিভ মেডিসিন, প্রাণী আচরণ, প্রাণী কল্যাণ, গণস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে প্র্যাকটিস অথবা গবেষণা কার্যক্রমে নিযুক্ত হন। আবার প্রজাতি ভেদে ভেটেরিনারি ডাক্তারগণ দুগ্ধজাত কিংবা মাংসজাত গবাদিপ্রাণী, পোল্ট্রি, পাখি, ঘোড়া, ক্যানাইন (কুকুর জাতীয়), ফেলাইন (বিড়াল জাতীয়), ভক্ষণযোগ্য প্রাণী, ল্যাবরেটরি প্রাণি, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণী, চিড়িয়াখানার প্রাণি, জলজ প্রাণি, সামুদ্রিক বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী প্রাণী উৎপাদনের মূলনীতি (বাসস্থান, খাদ্য ও প্রজনন ব্যবস্থাপনা), প্রাণি পুষ্টি, প্রাণিজাত খাদ্যপণ্যের বাজারজাতকরণ এবং খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো ভেটেরিনারি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার কোর কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয়গুলোকে প্রি-ভেটেরিনারি সায়েন্স বলে। গাইডলাইনে সুস্পষ্টভাবে এটাও উল্লেখ আছেঃ মৌলিক ভেটেরিনারি সায়েন্স এবং এনিম্যাল প্রডাকশন সম্পর্কিত বিষয়গুলো ভেটেরিনারি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের শুরুর দিকে পড়াতে হবে অথবা এই বিষয়গুলোকে ভেটেরিনারি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তির পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে “ডিভিএম” কিংবা “এমবিবিএস” ডিগ্রীতে আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে মৌলিক বিজ্ঞান অথবা সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে অনার্স ডিগ্রী থাকা বাধ্যতামূলক। এ্যাসোসিয়েশন অব অ্যামেরিকান ভেটেরিনারি মেডিক্যাল কলেজের নির্দেশনা অনুযায়ী ডিভিএমে আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রি-ভেটেরিনারি সায়েন্সের (এনিম্যাল সায়েন্স/হাজবেন্ড্রি, এনিম্যাল নিউট্রিশন এবং জেনেটিক্স) কথা উল্লেখ আছে।এই প্রি-ভেটেরিনারি সায়েন্সের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে “এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি” নামে ব্যাচেলর ডিগ্রী দেওয়া হচ্ছে। প্রি-ভেটেরিনারি সায়েন্স নিয়ে দেশে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম চালু থাকা দোষের কিছু না। কিন্তু প্রি-ভেটেরিনারি সায়েন্সকে ভেটেরিনারি সায়েন্সের সমতুল্য ভাবা এবং সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পশুপালন ডিগ্রীধারীরা নিজেদেরকে ভেটেরিনারি ডাক্তারের চেয়ে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ভাবা অবশ্যই দোষের কিছু। ভেটেরিনারি ডাক্তারদের কাজ শুধুমাত্র প্রাণি চিকিৎসা ইত্যাদি প্রচার করে ভেটেরিনারিয়ানদের প্রতিষ্ঠিত অধিকার খর্ব করার চেষ্টা এবং প্রাণিসম্পদ বিভাগে কাজ ভাগাভাগি করার উদ্দেশ্যে বিদ্যমান “বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল আইন-২০১৯” এর বেশিরভাগ নকল করে “বাংলাদেশ এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন-২০২৩” প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়ে পশুপালন ডিগ্রীধারীরা প্রানিসম্পদ বিভাগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন।
এমবিবিএস ডাক্তাররা নিউট্রিশন এন্ড ফুড সায়েন্স, ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন, পেডিয়াট্রিক নিউট্রিশন ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে মানুষের পুষ্টিরোগ বিশেষজ্ঞ অথবা পুষ্টিবিদ হিসেবে কাজ করছেন। আবার নিউট্রিশন এন্ড ফুড সায়েন্স অথবা ফুড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটরাও মানুষের ডায়েটিশিয়ান বা পুষ্টিবিদ হিসেবে কাজ করছেন। তাই বলে শেষোক্ত পুষ্টিবিদেরা নিজেদেরকে এমবিবিএস ডাক্তারের চেয়েও বড় পুষ্টিবিদ দাবি করে স্বাস্থ্য ক্যাডারে চাকুরি করছেন না। পুষ্টিবিদ হিসেবে নিজেদের পেশাজীবী দাবি করে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইনের অনুলিপি তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছেন না বরং স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু ক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন।
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নিয়ন্ত্রিত পেশা আছে হাতেগোনা কয়েকটি। তার মধ্যে ভেটেরিনারি পেশা অন্যতম। কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রিত পেশায় প্র্যাকটিস করার পূর্বে সরকারি রেগুলেটরি বডি থেকে লাইসেন্স গ্রহন করা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও নিয়ন্ত্রিত পেশাগুলোর জন্য সরকারি রেগুলেটরি বডি রয়েছে যেগুলো প্রফেশনাল কাউন্সিল (যেমন বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল, বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ইত্যাদি) হিসেবে পরিচিত। প্রফেশনাল কাউন্সিল গঠিত হয় জনগণের স্বার্থে (মানুষ ও প্রাণীর জীবনের সুরক্ষার জন্য) আর এসোসিয়েশন হয় গোষ্ঠীর স্বার্থে। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেশা না হয়েও পশুপালন ডিগ্রিধারীদের জন্য নিয়ন্ত্রিত পেশার অনুরূপ বাংলাদেশ এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল কার স্বার্থে গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে? তাও আবার বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল আইন-২০১৯ কে নকল করে!
প্রাণিসম্পদ বিভাগে দুই ডিগ্রীদারীদের দ্বন্ধ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছিলো অতীতের সকল সরকার। নাহয় এতদিনে মাঠ পর্যায়ে প্রান্তিক খামারিরা ভেটেরিনারি জেনারেলিস্টের পরিবর্তে অনেক ভেটেরিনারি স্পেশালিস্টের সেবা পেতো। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের প্রচেষ্টায় এবং দুই ডিগ্রিধারীদের সমঝোতায় প্রাণি চিকিৎসা, উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনায় এক ডিগ্রী প্রবর্তনে অনেকদূর এগিয়েছিলো প্রানিসম্পদ বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করে দিয়েছে পশুপালন ডিগ্রীধারীরা। তাহলে দীর্ঘদিনের দ্বন্ধ জিইয়ে রেখে প্রাণিসম্পদ বিভাগের পশ্চাৎযাত্রা ঠেকাবে কে?