17/07/2020
কোয়েল পাখি পালন, চিকিৎসা সহ বিস্তারিত নিচে দেওয়া হল:-
লেয়ার কোয়েলঃ মুরগির মতো কোয়েলের মধ্যেও লেয়ার জাত বিদ্যমান। এই জাতের উল্লেখযোগ্য গোষ্টি হলো-ফারাও, ইংলিশ হোয়াই, ম্যানচিরিয়াল গোল্ডেন, ব্রিটিশ রেঞ্জ ইত্যাদি। এই জাতের কোয়েলকে শুধু ডিম প্রদানের জন্য পালন করা হয়ে থাকে।
ব্রয়লার কোয়েলঃ মুরগির মতো কোয়েলের মধ্যে ব্রয়লার জাত বিদ্যমান এই জাতের উল্লেখযোগ্য গোষ্টি হলো আমেরিকান বব হোয়াইট কোয়েলে ইন্ডিয়ান হোয়াইট ব্রেস্টেড কোয়েল ইদ্যাদি। এই জাতের কায়েলকে শুধু মাংসের জন্য পালন করা হয়ে থাকে।
একটি পূর্ণবয়স্ক কোয়েল সর্বোচ্চ ৪ বছর বেচে থাকে। এই বয়সের মধ্যে সে অন্ততপক্ষে ৮০০ থেকে ১২০০ ডিম প্রদান করে থাকে। একটি পূর্ণাঙ্গ কোয়েলের ওজন ১৫০ থেকে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। ডিমের ওজন হয়ে থাকে ৮ থেকে ১২ গ্রাম। কোয়েলের ডিম দেখতে খুব সুন্দর কারুকার্যখচিত বলে মনে হয়। এরেদ ডিমের খোসার ওপর নীল, বেগুনী, খয়েরি এবং কালো রঙ্গের ছোট ছোট পোটা বা ছিট ছিট দাগ থাকে। অনেকে এই দাগের জন্য এই ডিমগুলো খাওয়ার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে থাকেন। কোয়েলের প্রতিটি ডিমই আসলে ভবিষ্যতের পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা। অর্থাৎ প্রতিটি ডিম থেকেই একটি বাচ্চা ফুটতে পারে। তবে বাচ্চাপ ফোটার জন্য ডিম তৈরি করতে হলে একটি পুরষ কোয়েলের সাথে তিনটি স্ত্রী কোয়েলকে কিছুদিন একসাথে রাখতে হবে। কোয়েলের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটর ব্যবহার কা হয়। তবে যাদের ইনকিউবেটরন নেই তারা সাধালনত কুচ্ছে মুরগির পেটের তলে দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে থাকেন। কারণ কার্যত কোয়েল পাখি কখনও কুঁচ্চে হয় না। ফলে কোয়েলের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে কুঁচ্চে মুরগির কিংবা ইনকিউবেটরের সহায়তা নিতে হয়।
ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১৭ থেকে ১৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে বাচ্চা ফোটার পরই সেগুলো পরিবেশের সাথে সরাসরি মানিয়ে নিতে পারে না। কারণ, কোয়েলের বাচ্চা খবই সংবেদনশীল। এরা পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় নেয়। এই সময়টাতে বাচ্চার প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে হয়। এইসময় বাচ্চাকে কোয়েলের সাধারণ খাচা থেকে সরিয়ে ব্রুডিং ঘরে নিয়ে যাওয়া ভাল। কারণ, সেই সময় বাহ্যিক উত্তাপ প্রয়োজন হয় বাচ্চার। ব্রুডিং পদ্ধতিতে বাচ্চার শরীর সেই সময় গরম করতে হয়।
কোয়েলের বিভিন্ন রোগ ব্যাধির মধ্যে আমাশয় উল্লেখ্যযোগ্য। এই রোগ হলে কোয়েলের ঘন ঘন পায়খানা হয়, খাবার গ্রহনে অনীহা দেখা দেয় পাশাপাশি কোয়েলের স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। এই অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এম্বাজিন জাতীয় ঔষধ খাওয়ানো যেতে পারে।
তবে সবচেয়ে বড়ো কথা, সুষ্ঠুভাবে কোয়েল পালন করতে হলে তাদের থাকার জায়গা বা বাসস্থান, খাবার জায়গা ইত্যাদি স্থানগুলো শুকনা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। পর্যাপ্তআরৌ বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই সাথে প্রয়োজনীয় সুষমত খাদ্যের সরবরাহ রাখতে হবে। তবেই কোয়েল পালন করে তার মাংস ও ডিম উৎপাদনে সঠিক ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
পুনরুৎপাদন কোয়েলের বয়স ১০-২০ সপ্তাহ হলেই তারা বছরের প্রায় সকল ঋতুতেই পুনরুৎপাদন করে থাকে। স্ত্রী কোয়েল যেন একটি মেশিন, প্রতি ১৬ থেকে ২৪ ঘন্টায় ১টা করে ডিম পাড়ে এবং ৮-১২ মাস পর্যন্ত ডিম পাড়া অব্যাহত থাকে। শুধুমাত্র ডিম ফুটাতে চাইলে স্ত্রী কোয়েল প্রতিপালন অধিক লাভজনক। ডিমের উর্বরতা আশানুরূপ পেতে হলে ২:১, ৫:২ বা ৩:১ অনুপাতে স্ত্রী এবং পুরুষ কোয়েল একত্রে রাখতে হবে। তবে অর্থনৈতিক দিক দিক বিবেচনা করে ৩:১ অনুপাত অপেক্ষাকৃত ভাল । স্ত্রী কোয়েলের সাথে পুরুষ কোয়েল রাখায় ৪ দিন পর থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করা উচিত এবং স্ত্রী কোয়েল থেকে পুরুষ কোয়েল আলাদা/পৃথক করার পর তৃতীয় দিন পর্যন্ত ফুটানোর ডিম সংগ্রহ করা যেতে পারে।
স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কোয়েল ৬-৭ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে। ৮-১০ সপ্তাহ বয়সে ৫০% ডিম পাড়ে এবং ১২ সপ্তাহের পর থেকে ৮০% ডিম পাড়ে। উপযুক্ত পরিবেশে প্রথম বছর গড়ে ২০০-২৫০টি ডিম পাড়ে। দ্বিতীয় বছরে ডিমের উৎপাদন প্রথম বছরের উৎপাদনের শতকরা ৪৮ ভাগ হয়। কোয়েলের ডিমের উর্বরতা স্বাভাবিক অবস্থায় শতকরা ৮২-৮৭ ভাগ। তবে কোয়েলের ডিমের ফার্টিলিটি এবং হ্যাচ্যাবিলিটি পরিবর্তনশীল অথার্ৎ ফার্টিলিটি এবং হ্যাচিবিলিটি কম বেশি হতে পারে। ডিমপাড়া শুরুর প্রথম দুই সপ্তাহের ডিম ফোটানো উচিত নয়। ৫০ সপ্তাহের অধিক বয়সের কোয়েলের ডিমের উর্বরতা এবং ফোটার হার কম। কোয়েলের ডিমের গড় ওজন ১০-১২ গ্রাম এবং গড়ে সারা বছর শতকরা ৬০ ভাগ ডিম দেয়। ডিমের ওজন স্ত্রী কোয়েলের দৈহিক ওজনের ৮%। কোয়েল এক বাণিজ্যিক বছরের অধিককাল পালন করা উচিত নয় কারণ তখন ডিম উৎপাদন খুবই কমে যায়। আন্তঃপ্রজনন যাতে না হয় সেজন্য নিকট সমপর্কযুক্ত কোয়েলের মধ্যে প্রজনন করানো যাবে না।
ডিমের রং, আকার ও আকৃতি শুধুমাত্র কিছু প্রজাতির কোয়েল সাদা রংয়ের ডিম পাড়ে। তাছাড়া বেশির ভাগ কোয়েলের ডিম বাদামী এবং গায়ে ফোঁটা ফোঁটা দাগ আছে।
ইনকিউবেটরে বসানোর পূর্বে ডিমের যত্ন দিনে অন্তত দু'বার ফোটানোর ডিম সংগ্রহ করতে হবে এবং ১৫.৫০ সে তাপমাত্রায় ৮০% আর্দ্রতায় ৭-১০ দিন সংরক্ষণের জন্য ২০ মিনিট ফরমালডিহাইড গ্যাসে রাখতে হবে। কোয়েলের ডিমের খোসা ভাঙ্গার প্রবণতা বেশি থাকায় ডিম অত্যন্ত সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয়। ডিম দূষিত হওয়ার প্রধান উৎস এবং রোগ বিস্তারের মুখ্য কারণ হচ্ছে ময়লাযুক্ত ইনকিউবেটর অথবা হ্যাচারী এলাকা প্রতিবার ব্যবহারের পর প্রতিটি হ্যাচিং ইউনিট ভালভাবে ধৌত করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। বাজারে যে সমস্ত উন্নতমানের জীবাণুনাশক পাওয়া যায় সেগুলো ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত করা যেতে পারে। ময়লাযুক্ত ডিম রোগ ও জীবাণুর প্রধান উৎস। কাজেই সর্বদা পরিষ্কার-পরিচছন্ন ডিম বসাতে হবে। বাচ্চা ফুটানোর ডিম কখনও ধোয়া উচিত নয়। ডিম সংগ্রহ করার পর ডিম ফিউমিগেশন করা উচিত অথবা বিকল্প ইনকিউবেটরে ডিম বসানোর ১২ ঘন্টার মধ্যে ফিউমিগেশন করা উচিত।
কোয়েলের বাচ্চা ফোটানো স্বাভাবিক নিয়মে ১৭-১৮ দিনে উপযুক্ত পরিবেশে ডিম হতে বাচ্চা ফুটে। অবশ্য তা প্রজাতি বা ইনকিউবেশন পদ্ধতির উপরও নির্ভর করে। বাণিজ্যিক কোয়েল ডিমে তা দেয় না। ফলে এদের দিয়ে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব নয়। কোয়েলের ডিম সাধারণত কৃত্রিম উপায়ে ইনকুবেটর দিয়ে ফোটানো হয়। সফলভাবে বাচ্চা ফোটানোর হার বেশি পেতে হলে ইনকিউবেটর নির্মাতার নির্দেশ সতর্কতার সাথে পালন করতে হবে। ইনকুবেটরের কিছু কিছু মডেল শুধুমাত্র কোয়েলের ডিম বসানোর জন্যই ডিজাইন করা হয়। জাপানীজ কোয়েলের ডিম মুরগীর ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহৃত ইনকুবেটরে ফোটানো যেতে পারে তবে ডিম বসানোর ট্রেগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন আনা দরকার। ডিমের মোটা অংশ সেটিং ট্রেতে বসানো উচিত। নিয়মমাফিক কোয়েলের ডিম প্রথম ১৫ দিন সেটিং ট্রেতে এবং পরবর্তী ৩ দিন হ্যাচিং ট্রেতে দিতে হবে। তাপমাত্রা ৯৮-১০১০ ফা এবং প্রথম ১৫ দিন ৫০-৬০% আর্দ্রতা এবং পরবর্তীতে ৬০-৭০% আর্দ্রতা রাখা বাঞ্ছনীয় (ইনকুবেটর নির্মাতার নির্দেশ অনুসারে)। প্রতি ২ থেকে ৪ ঘন্টা অন্তর ডিম ঘুরিয়ে (টার্নিং) দিতে হবে যাতে ভ্রূণ খোসার সাথে লেগে না যায়। ১৫তম দিনে ডিম সেটিং ট্রে থেকে হ্যাচিং ট্রেতে স্থানান্তর করতে হবে এবং ডিম ঘুরানো বন্ধ করতে হবে। ডিম থেকে বের হওয়া বাচ্চা ২৪-২৮ ঘন্টার মধ্যে ব্রুডার ঘরে স্থানান্তর করতে হবে।
কোয়েলের বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা এবং যত্ন
সদ্য ফুটন্ত কোয়েলের বাচ্চা খুবই ছোট থাকে। এক দিন বয়সের কোয়েলের বাচ্চার ওজন মাত্র ৫-৭ গ্রাম থাকে। তাই ঠান্ডা বা গরম কোনটাই তারা সহ্য করতে পারে না। এমতাবস্থায় কাঙ্খিত তাপমাত্রা এবং খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বজায় রাখতে হবে। এ সময় কোন রকম ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা বা কোন রকম ধকল হলে এর বিরূপ প্রভাব দৈহিক বৃদ্ধি, ডিম উৎপাদন এবং জীবনি শক্তির থাকার উপর পড়ে। বাচ্চাকে তাপ দেয়া বা ব্রুডিং সাধারণত দুই পদ্ধতিতে করা যায়। যেমনঃ খাঁচায় বা কেইজে ব্রুডিং এবং মেঝেতে ব্রুডিং। যে পদ্ধতিতেই তাপ দেয়া হোক না কেন তাপমাত্রার প্রয়োজনীয়তা একই রকম। প্রথম সপ্তাহে সাধারণত ৩৫০সে তাপমাত্রা দিয়ে ব্রুডিং আরম্ভ করা হয় এবং এই তাপমাত্রা প্রতি সপ্তাহে পর্যায়ক্রমে ৩.৫০সে কমিয়ে নিম্নলিখিত মাত্রায় আনতে হবে।
উপরে যে তাপের উল্লেখ করা হলো তা হলো ব্রুডারের তাপমাত্রা। থার্মোমিটারের সাহায্যে সরাসরি এই তাপমাত্রা নিরূপণ করা যায়। তবে থার্মোমিটার ছাড়াও ব্রুডারের তাপ সঠিক হয়েছে কি না তা ব্রুডারের বাচ্চার অবস্থান দেখে বুঝা যায়। বাচ্চারা যদি বাল্বের কাছে জড়োসড়ো অবস্থায় থাকে তবে বুঝতে হবে তাপমাত্রা কম হয়েছে। আর যদি বাল্ব থেকে দূরে গিয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে তাপমাত্রা অধিক। অন্যদিকে বাচ্চাগুলো যদি চারিদিকে সমভাবে ছড়িয়ে থাকে এবং স্বাভাবিক ঘুরাফেরাসহ খাদ্য পানি গ্রহণ করতে থাকে তবে বুঝতে হবে পরিমিত তাপমাত্রা আছে। বাংলাদেশে গরমের সময় দুই সপ্তাহ এবং শীতের সময় তিন চার সপ্তাহ কৃত্রিম উপায়ে তাপ দিতে হয়। গবেষণা থেকে জানা যায় যে, দুই সপ্তাহ কেজে ব্রুডিং করে পরবর্তীতে মেঝেতে পালন করলে মৃত্যু হার অনেক কম হয় এবং বাচ্চার ওজন অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। কোয়েলের মৃত্যুহার নির্ভর করে এদের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার উপর। ব্রুডিংকালীন পর্যাপ্ত তাপ প্রদান করতে না পারলে বাচ্চার মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। কাজেই এ সময়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আর বয়স্ক কোয়েলের মৃতু্যহার তুলনামূলকভাবে খুব কম।
ইনকুবেটরে বাচ্চা ফোটার ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্রুডিং ঘরে এনে প্রথমে গ্লুকোজ মিশ্রিত পানি এবং পরে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্যের সাথে সাথে পর পর তিনদিন গ্লুকোজ পানি পান করতে দেয়া ভাল। তারপর এমবাভিট ডবি্লও এস পানির সঙ্গে তিন দিন সরবরাহ করতে হবে। প্রথম সপ্তাহ খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হবে এবং প্রতিদিন খবরের কাগজ পরিবর্তন করতে হবে। এক সপ্তাহ পর ছোট খাবার পাত্র বা ফ্লাট ট্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। পানির পাত্রে বাচ্চা যাতে পড়ে না যায় সেজন্য মার্বেল অথবা কয়েক টুকরা পাথর খন্ড পানির পাত্রে রাখতে হবে। সর্বদাই পরিষ্কার-পরিচছন্ন পানি সরবরাহ করতে হবে।
অন্যান্য পোল্ট্রির মত কোয়েলের জীবন চক্রকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ বাচ্চা, বাড়ন্ত এবং বয়স্ক। অনেকে আবার কোয়েলের জীবনচক্র সংক্ষিপ্ত বিধায় তাকে শুধু বাচ্চা এবং বয়স্ক এই দুইভাগে ভাগ করেন। স্বাভাবিকভাবে ১-৩ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চা বলা হয়। ৩-৫ সপ্তাহ বয়সের কোয়েলকে বাড়ন্ত এবং ৫ সপ্তাহের অধিক বয়সের কোয়েলকে বয়স্ক বলে। অধিকতর সহজ ব্যবস্থাপনার জন্য এই অধ্যায়ের কোয়েলের জীবন চক্রকে দুই ভাগে যেমনঃ ১-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চা এবং তিন সপ্তাহের বেশি বয়েসের কোয়েলকে বয়স্ক কোয়েল বলে অভিহিত করা হয়েছে।
খাবার পাত্র বাচ্চা অবস্থায় ফ্লাট ট্রে বা ছোট খাবার পাত্র দিতে হবে যেন খাবার খেতে কোনো রকম অসুবিধা না হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রতি ২৮টি বাচ্চার জন্য একটি খাবার পাত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫০৩ সেমি, প্রস্থ ৮ সেমি এবং উচ্চতা ৩ সেমি) এবং প্রতি ৩৪ টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য একটি খাবার পাত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫৭ সেমি প্রস্থ ১০ সেমি এবং উচ্চতা ৪ সেমি) ব্যবহার করা যেতে পারে। দিনে দুইবার বিশেষ করে সকালে এবং বিকালে খাবার পাত্র ভাল করে পরিষ্কার করে মাথা পিছু দৈনিক ২০-২৫ গ্রাম খাবার দিতে হবে। উল্লেখ্য প্রথম সপ্তাহ থেকে ৫ গ্রাম দিয়ে শুরু করে প্রতি সপ্তাহে ৫ গ্রাম করে বাড়িয়ে ২০-২৫ গ্রাম পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রতিটি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১.২৫ থেকে ২.৫ সেমি (১/২ থেকে ১ ইঞ্চি) খাবার পাত্রের জায়গা দিতে হবে।
পানির পাত্র সর্বদাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ০.৬ সেমি (১/৪ ইঞ্চি) পানির পাত্রের জায়গা দিতে হবে। অটোমেটিক বা স্বাভাবিক যে কোনো রকম পানির পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি ৫০টি কোয়েলের জন্য একটি পানির পাত্র দেয়া উচিত। নিপল ড্রিংকার বা কাপ ড্রিংকারও ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি ৫টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১টি নিপল বা কাপ ড্রিংকার ব্যবহার করা যেতে পারে।
আলোক ব্যবস্থাপনা কাঙ্খিত ডিম উৎপাদন এবং ডিমের উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য দৈনিক ১৪-১৮ ঘন্টা আলো প্রদান করা প্রয়োজন। শরৎকাল এবং শীতকালে দিনের আলোক দৈর্ঘ্য কম থাকে তাই কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয় । পুং কোয়েল, যেগুলো প্রজনন কাজে এবং শুধুমাত্র মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় সেগুলোর জন্য দৈনিক ৮ ঘন্টা আলোকই যথেষ্ট। প্রাকৃতিক আলোর সাথে কৃত্রিম আলোর সমন্বয় করে নিম্ন সারণী মোতাবেক আলো দিলে কাঙ্খিত ডিম উৎপাদন সম্ভব।
বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থাপনা
পুষ্টি
বাচ্চা, বাড়ন্ত অথবা প্রজনন কাজে ব্যবহৃত কোয়েলের স্ট্যান্ডার্ড রেশন বাজারে সহজলভ্য নয়। কোয়েলের রেশনকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ স্টার্টার (০-৩ সপ্তাহ), বাড়ন্ত (৪-৫ সপ্তাহ) এবং লেয়ার বা ব্রিডার (৬ সপ্তাহ পর্যন্ত কোয়েলের প্রতিকেজি খাবারে ২৭% প্রোটিন এবং ২৮০০ কিলো ক্যালরী বিপাকীয় শক্তি)। বাড়ন্ত কোয়েলে প্রতি কেজি খাবারে ২৩% প্রোটিন এবং ২৭০০ কিলোক্যালোরী বিপাকীয় শক্তি এবং লেয়ার কোয়েলের প্রতিকেজি খাবারে ২২-২৪% প্রোটিন এবং ২৭০০ কিলোক্যালোরী বিপাকীয় শক্তিতে ভাল ফল পাওয়া যায়। ডিম পাড়া কোয়েলে প্রতি কেজি খাবারে ২.৫-৩.০% ক্যালসিয়াম থাকতে হবে। তবে গরমের সময় ডিমের উৎপাদন সঠিক রাখার জন্য ৩.৫% ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজন হয়।
রোগ বালাই
কোয়েলের রোগবালাই নেই বললেই চলে। সাধারণত কোনো ভ্যাকসিন অথবা কৃমিনাশক ঔষধ দেয়া হয় না। তবে বাচ্চা ফুটার প্রথম ২ সপ্তাহ বেশ সংকটপূর্ণ। এ সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোয়েলের বাচ্চার যত্ন নিতে হয়। বাচ্চা অবস্থায় অব্যবস্থাপনার কারণে কোয়েলের বাচ্চা মারা যায়। তবে, বয়স্ক কোয়েলের মৃত্যুহার খুবই কম।
কোয়েল পালন উৎপাদনের দিক থেকে অধিক লাভজনক। অন্যান্য পোল্ট্রির তুলনায় কোয়েলের মাংস এবং ডিম গুণগতভাবে শ্রেষ্ঠ। কোয়েলের ডিমে কোলেস্টরলের পরিমাণ কম এবং আমিষ বেশি। একটি মুরগীর পরিবর্তে ৮ টি কোয়েল পালন করা যায়। অল্প জায়গায় বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় অল্প খরচে পারিবারিক পর্যায়ে অথবা বাণিজ্যিকভিত্তিতে কোয়েল পালন দেশে পুষ্টি ঘাটতি দূরীকরণে এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
ব্রুডার নিউমোনিয়া আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে বাচ্চা কোয়েলের মৃত্যু হতে পারে, যদি না ব্রুডারে থাকাকালীন তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখা যায়৷ তাই ব্রুডিং করার সময় অর্থাত প্রথম দুই সপ্তাহ বাচ্চা কোয়েলকে নজরে রাখতে হবে৷ কারণ ঐ সময় আসপারজিলাস ফিউমিগেটাস নামক ছত্রাকের প্রভাবে এই ব্রুডার নিউমোনিয়া হয়৷
রোগের লক্ষণ বাচ্চাপাখী ঝিমিয়ে পড়ে, দুর্বল হয়ে পড়ে, খাওয়া দাওয়াবন্ধ হয়ে যায়৷ জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে৷ চোখ লাল হয়ে যায়, চোখ থেকে রস বেরোতে থাকে৷ এই রোগে মৃত্যুর হার শতকরা ২ - ৩ ভাগ৷ কিন্তু আক্রান্তের হার শতকরা ৫০ ভাগ৷
চিকিত্সা ২ গ্রাম ক্যালসিয়াম প্রোপিওনেট ১০০ কেজি খাবারের সাথে মেশাতে হবে৷ আন্টিবায়টিক খাওয়াতে হবে৷ পাশাপাশি প্রাণীচিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে৷
কোয়েল ডিজিজ কোয়েল ডিজিজের আর এক নাম আলসারেটিভ এনটারাইটিস৷ এটি কোয়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ৷
রোগের লক্ষণ পাতলা পায়খানা, দুর্বল হয়ে পড়ে, খিচুনি হয়, ক্ষুদ্রান্ত্রে ও শিকামে ঘা হয়ে যায়৷
চিকিত্সা আন্টিবায়টিক খাওয়াতে হবে৷ পাখী খুব বেশী মারা গেলে স্থানীয় চিকিত্সকের কাছে পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খাওয়াতে হবে।
পৃথিবীতে যত প্রকার খাদ্য উপযোগী ডিম আছে তার মধ্যে কোয়েল পাখির ডিম গুনে মানে এং পুষ্টিতে সর্বশ্রেষ্ট। আমাদের সমাজে র্ফামের মুরগীর ডিম বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যার মধ্যে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই। কারণ এইগুলি মোরগ ছাড়া ডিম। এর বাচ্চা হয় না। অপর পক্ষে কোয়েলের ডিম বাচ্চা উৎপাদন করতে সক্ষম তাছাড়া পুষ্টিগুন ও অন্নান্য ডিম থেকে অনেক অনেক শ্রেয়।
৪০ বছর পার হলেই ডাক্তারের নির্দেশ থাকে মুরগীর ডিম খাওয়ার ব্যাপারে সর্তক থাকুন। কারণ নিয়মিত মুরগীর ডিম খেলে কলোস্ট্ররেল বেড়ে হৃদ রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বয়স্ক লোকদের এই অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং অতীব সুস্বাদু খাদ্য ডিম খাওয়া থেকে বিরক্তি ভাবে বিরত থাকতে হয়। অথচ কোয়েলের ডিম নিসংকোচে যে কোনো বয়সের মানুষ অর্থ্যাৎ বাচ্চা থেকে বৃদ্ধরা খেতে পারে।
এতে ক্ষতির কোনো কারণ নেই বরং নিয়মিত কোয়েলের ডিম গ্রহণ করলে অনেক কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য লাভ হতে পারে। বিভিন্ন দেশে কোয়েল পাখির ডিম নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং সব জায়গা থেকে গবেষকরা কোয়েলের ডিম খাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
কোয়েলের রোগব্যাধি ও প্রতিকার
কোয়েল পালনের অন্যতম সুবিধা হল এরা মুরগী বা পোল্ট্রির তুলনায় রোগব্যাধিতে কম আক্রান্ত হয়৷ কিন্তু, তাই বলে যে রোগ একেবারে হয় না তা নয়৷ কোয়েলের রোগব্যাধি কম বলে এগুলোকে টিকা দিতে হয়না এবং কৃমির ঔষধও খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ে না৷
মুরগীর প্রায় সবগুলো সাধারণ রোগই কোয়েলকে আক্রান্ত করতে পারে৷ কোয়েল ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, মাইকোপ্লাজমা, পরজীবী, অপুষ্টি, ব্যবস্থাপনা ত্রুটি ও প্রজনন সংক্রান্ত ত্রুটির কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে৷ এখানে কোয়েলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হল৷
সাধারণ রোগ সমূহ
ক্ষত সৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ
ক্লোমনালী প্রদাহ
অ্যাসপারজিলোসিস বা ব্রুডার নিউমোনিয়া
কলিসেপ্টিসেমিয়া
রক্ত আমাশয়
স্পর্শজনিত চর্মপ্রদাহ
মারেক্স রোগ
লিম্ফয়েড লিউকোসিস
কৃমির আক্রমণ
কার্ল টো প্যারালাইসিস
ঠোকরা-ঠুকরি বা ক্যানিবালিজম
ডিম আটকে যাওয়া৷
১. ক্ষত সৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ (Ulcerative enteritis)
ক্ষতসৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ রোগটি ''কোয়েল'' (Quail disease) নামেও পরিচিত৷ কোয়েলের রোগব্যাধির মধ্যে এটিই সবচেয়ে মারাত্মক৷ আক্রান্ত কোয়েলের ১০০%-ও মারা যেতে পারে৷ সাধারণত লিটারে পালিত কোয়েলে এ রোগ বেশী দেখা যায়৷
কারণঃ এটি ব্যাকটেরিয়াজনিত অস্ত্রের রোগ৷ রোগের বিস্তারঃ সাধারণত দূষিত খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার মাধ্যমে বাচ্চা কোয়েল এ রোগে আক্রান্ত হয়৷ আক্রান্ত ঝাঁক থেকে সুস্থ ঝাঁকে কীটপতঙ্গের মাধ্যমে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম৷
লক্ষণঃ
তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী দু'ধরণের রোগই হতে পারে৷
মারাত্মকভাবে আক্রান্ত কোয়েল অনেক সময় কোন লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই মারা যেতে পারে৷
মৃদুভাবে আক্রান্ত কোয়েলে অবসাদ দেখা যায়৷
চোখ আংশিকভাবে বন্ধ করে রাখে এবং পাখা ঝুলে পড়ে৷
রক্তসহ পাতলা পায়খানা হয় এবং পাখির মৃত্যু ঘটে৷
দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে পাখি মাস খানেক রোগে ভুগে দুর্বল হয়ে মারা যায়৷
ময়লা তদন্তে (Post Morlem) অস্ত্র ও সিকান্ত্রে (Caeca) বোতাম আকৃতির মারাত্মক ক্ষত বা আলসার দেখা যায়৷
চিকিত্সাঃ চিকিত্সার জন্য ভেটেরিগরি সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দেশিত মাত্রায় ব্যাসিট্র্যাসিন (Bacitracin) স্ট্রেপটোমাইসিন (Streptomycin), ক্লোরোমাইসেটিন (Chloromycetin) বা এগুলোর পরিবর্তে টেট্রাসাইক্লিন (Tetracycline) অথবা ফুরাজোলিডন (furazolidone) সফলভাবে ব্যবহার করা যায়৷
প্রতিরোধঃ গবেষণায় দেখা গেছে, ৪.৫ লিটার খাবার পানিতে ২ গ্রাম মাত্রায় স্ট্রেপটোমাইসিন মিশিয়ে একাধারে২৫ দিন অথবা স্ট্রেপটোমাইসিন সালফেট মিশিয়ে একাধারে ১০ দিন পান করালে ও রোগ পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যায়৷
২. ক্লোমনালী প্রদাহ (Bronchitis)
কোয়েলের ক্লোমনালী প্রদাহ একটি তীব্র প্রকৃতির প্রদাহজনিত রোগ৷ রোগটি তিন সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে৷ সব বয়সের কোয়েল এতে আক্রান্ত হলেও বাচ্চা কোয়েলের ক্ষেত্রে ৮০% পর্যন্ত মৃত্যু ঘটতে পারে৷
কারণঃ এক ধরণের ভাইরাসের আক্রমণে কোয়েল এ রোগে আক্রান্ত হয়৷
লক্ষণঃ
আক্রান্ত কোয়েলে হাঁচি, কাশি ও অস্বাভাবিক শ্বাসের শব্দ লক্ষ্য করা যায়৷
কোন কোন সময় চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং কনজাংটিভাইটিসও (Conjunctivitis) দেখা যায়৷
স্নায়বিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে৷
চিকিত্সাঃ ভাইরাসঘটিত রোগ বিধায় এর কোন চিকিত্সা নেই৷ তবে আক্রান্ত কোয়েল চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গে বাকিগুলোর কাছ থেকে পৃথক করে সরিয়ে ফেলতে হবে৷ ব্যাকটেরিয়াজনিত মাধ্যমিক সংক্রমণ (Secondary infection) থেকে এদের রক্ষার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন- টেট্রাসোইক্লিন) ব্যবহার করা যেতে পারে৷
প্রতিরোধঃ পাখির ঝাঁকে (Flock) গাদাগাদি অবস্থা পরিহার করে সেখানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল এবং খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা করতে হবে৷
৩. অ্যামপারজিলোসিস বা ব্রুডার নিউমোনিয়া (Brooder pneumonia)
এতে প্রধাণত ব্রুডিং পর্বের বাচ্চা কোয়েল আক্রান্ত হয়৷ তাই এই রোগকে ব্রুডার নিউমোনিয়া বলা হয়৷
কারণঃ বাচ্চা মুরগীতে ব্রুডার নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ''অ্যাসপারজিলাস ফিউমিগেটাস (Aspergillus fumigtus) নামক ছত্রাকের স্পোর এই রোগের কারন৷
রোগের বিস্তারঃ স্পোর দিয়ে দূষিত খাদ্য বা লিটার সামগ্রীর সংস্পর্শে অথবা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে স্পোর গ্রহণে বাচ্চা কোয়েল এই রোগে আক্রান্ত হয়৷
লক্ষণঃ
তীব্র প্রকৃতির রোগে ক্ষুধামন্দা, পিপাসা বৃদ্ধি, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়৷
বাচ্চা শুকিয়ে যায় ও দুর্বল হয়ে পড়ে৷
শ্বাসকষ্টের কারনে বাচ্চা মুখ হা করে ঘাড় ও মাথা উপরের দিকে টান করে শ্বাস গ্রহণ করে৷
শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় ঘড়ঘড় শব্দ হয়৷
আক্রান্ত বাচ্চার চোখের পাতা ফুলে যায়৷ বয়স্ক বাচ্চার কর্ণিয়া (Cornea) -তে আলসার বা ঘা দেখা দিতে পারে৷
অতি তীব্র প্রকৃতির রোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনো বৈশিষ্টপূর্ণ উপসর্গ ছাড়াই বাচ্চা মারা যেতে পারে৷
চিকিত্সাঃ
রোগাক্রান্ত পাখিকে ভেটরিনারি সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য বা পানির সাথে ছত্রাকনাশক ঔষধ মিশিয়ে খাওয়ানোর যায়, কপার সালফেট ১ঃ২০০০ মাত্রায় খাবার পানিতে মিশিয়ে পান করালে বাচ্চা তাড়াতাড়ি সেরে উঠে৷
প্রতিরোধঃ ঘরের আর্দ্রতা কমিয়ে ও প্রতি কেজি খাদ্যে দুই গ্রাম মাত্রায় ক্যালসিয়াম প্রোপিওনেট (Calcium Propionate) মিশিয়ে খেতে দেয়া যেতে পারে৷ তাছাড়া ঘরের লিটার সবসময় শুকনো রাখতে হবে এবং ব্রুডার এলাকার লিটার নির্দিষ্ট সময় পরপর উল্টেপাল্টে দিতে হবে৷ জমাট বাঁধা, ভিজা ও ছত্রাকযুক্ত লিটার ফেলে দিতে হবে৷
৪. কলিসেপ্টিসেমিয়া (Colisepticemia)
কোয়েলের এই মারাত্মক রোগে সব বয়সের পাখিই আক্রান্ত হতে পারে৷ এতে প্রধানত শ্বাসতন্ত্র আক্রান্ত হয়৷ তবে অন্যান্য তন্ত্রও আত্রান্ত হতে পারে৷
কারণঃ ''ইসকোরিশিয়া কলাই'' (Escherichia coli) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমনে কোয়েল এই রোগে আক্রান্ত হয়৷
লক্ষণঃ
সাধারণত রোগের লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই পাখির মৃত্যু ঘটে৷
হঠাত্ পাখির মৃত্যুহার বেড়ে যায়৷
শ্বাসতন্ত্রের উপসর্গ, যেমন-মুখ হা করে থাকে, নাকে-মুখে ফেনা ওঠে৷
চোখ দিয়ে পানি পড়ে৷
চিকিত্সাঃ প্রতি ৫-১০ কেজি খাদ্যে ৫০০ মি.গ্রা. মাত্রার একটি টেট্রাসাইক্লিন (যেমন বেনামাইসিন) ট্যাবলেট মিশিয়ে আক্রান্ত পাখিবে ৩-৫ দিন খাওয়াতে হবে৷ এছাড়া পানির মাধ্যমেও উক্ত ঔষধ পান করানো যায়৷
৫. রক্ত আমাশয় (Coccidiosis)
রক্ত আমাশয় বা ককসিভিওসিস রোগ মুরগীতে যতটা মারাত্মক আকারে দেখা দেয় কোয়েলের ক্ষেত্রে ততটা নয়৷ সাধারণত বাচ্চা কোয়েল এই রোগো আক্রান্ত হয়ে থাকে৷
কারণঃ ''আইমেরিয়া বটেরি'' (Eimeria bateri), ''আইমেরিয়া উজুরা'' (Eimeria Uzura) ও ''আইমেরিয়া সুনোডাই (Eimeria tsunodai) নামক ককসিডিয়া দ্বারা বাচ্চা কোয়েল আক্রান্ত হতে পারে৷
লক্ষণঃ আক্রান্ত বাচ্চা ঝিমাতে থাকে, রক্ত পায়খানা করে ও দূর্বল হয়ে পড়ে৷ অবশেষে রক্তশূন্যতার কারণে মারা যায়৷
চিকিত্সাঃ প্রতি কুইন্টাল খাদ্যে ১২৫ গ্রাম মাত্রায় অ্যাম্প্রোলিয়াম (Amproluum) মিশিয়ে পরপর তিন দিন আক্রান্ত বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে৷
প্রতিরোধঃ ককসিডিওসিস রোগ প্রতিরোধ করতে হলে-
(ক) খামারে স্বাস্থ্যসম্মত ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে৷
(খ) জন্মের দিন থেকে দু'সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি কুইন্টাল খাদ্যে ৬২.৫ গ্রাম মাত্রায় অ্যাম্প্রোলিয়াম খাওয়াতে হবে৷
৬. মারেক্স রোগ (Marek's disease)
মারেক্স রোগ স্নায়ুতন্ত্রের টিউমার সৃষ্টিকারী মারাত্মক ধরণের সংক্রামক রোগ৷ এতে প্রধানত প্রান্তীয় স্নায়ু (যেমন- সায়াটিক ও ব্রাকিয়াল স্নায়ু) আক্রান্ত হয়৷ এমনকি একদিন বয়সের বাচ্চাও আক্রান্ত হতে পারে৷
কারণঃ এক ধরণের হায়পেস ভাইরাস কোয়েলে এই রোগ সৃষ্টি করে৷
রোগের বিস্তারঃ আক্রান্ত পাখির লালা নাকের শ্লেন্মা, মল ও পাখার ফলিকলের (Follicle) মাধ্যমে এই রোগ সুস্থ পাখিকে ছড়ায়৷
লক্ষণঃ
সায়াটিক ও ব্রাকিয়াল স্নায়ু মারাত্মক ভাবে ফুলে ওঠে এবং পক্ষাঘাতের সৃষ্টি করে৷
দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে পাখির ওজন হ্রাস পায় এবং ফ্যাকাসে হয়ে যায়৷
আক্রান্ত চোখ সাদা হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে একটি বা উভয় চোখই নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷
ক্ষুধামান্দ্য ও ডায়রিয়া দেখা দেয়৷ ফলে অনাহার ও পানিশূন্যতায় ভুগে পাখি মারা যায়৷
চিকিত্সা ও প্রতিরোধঃ এই রোগের কোন চিকিত্সা নেই৷ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও পাখিকে টিকা প্রদান করা উচিত৷ তবে কয়েল যেহেতু কদাচিত্ এই রোগে আক্রান্ত হয় তাই টিকার ব্যবহার প্রচলিত নয়৷
৭. লিম্ফয়েড লিউকোসিস (Lymphoid Leucosis)
লিম্ফয়েড লিউকোসিস এক ধরনের ক্যানসার৷ এটি সাধারণত বয়স্ক কোয়েলকে আক্রান্ত করে৷ আক্রান্ত কোয়েলের ডিম থেকে ফোটানো বাচ্চা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে৷
কারণঃ এটি অ্যাভিয়ান লিউকোসিস নামক ভাইরাসের কারণে হয়৷
লক্ষণঃ
আক্রান্ত পাখি দুর্বল ও কৃশ হয়ে পড়ে৷
টিউমার হওয়ার কারণে উদরস্ফীত হয়৷
রক্তশূন্যতা দেখা দেয় ও পাখি মারা যায়৷
চিকিত্সা ও প্রতিরোধঃ এই রোগের কোন ফলপ্রসূ চিকিত্সা ব্যবস্থা নেই৷ কার্যকরী টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি৷ এটি দূর করার জন্য আক্রান্ত পুরো ঝাঁককে মেরে ফেলা উচিত৷
৮. কৃমির আক্রমণ
খাঁচায় পালিত কোয়েলে কৃমির আক্রমণ ঘটে না৷ তবে, লিটারে পালিত কোয়েল কখনো কখনো গোল কৃমি ও ফিতা কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে৷ কোয়েল সাধারণত শীতকালেই বেশী আক্রান্ত হয়৷ তবে, কৃমি কোয়েলের তেমন কোন ক্ষতি করতে পারেনা৷
কারণঃ পাঁচ প্রজাতির গোল কৃমি বাচ্চা কোয়েল এবং এক প্রজাতির ফিতাকৃমি বয়ষ্ক কোয়েলকে আক্রমণ করতে পারে৷
লক্ষণঃ
আক্রান্ত পাখি পাতলা পায়খানা করে৷
পালক উস্কো খুস্কো হয়ে যায়৷
ধীরে ধীরে শরীর শুকিয়ে যায়৷
উত্পাদন হ্রাস পায়৷
চিকিত্সা ও প্রতিরোধঃ আক্রান্ত পাখিকে কৃমিনাশক ঔষধ, যেমন -থায়াবেনডাজল খাওয়ানো যেতে পারে৷ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে৷ তাছাড়া লিটারে পালিত ব্রিডিং ফ্লককে প্রতিরোধক মাত্রায় কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়ানো উচিত৷
৯. কার্লড টো প্যারালাইসিস (Curled toe paralysis)
সাধারণত ভিটামিনের অভাবজনিত কারণে কখনো কখনো বাচ্চা কোয়েলে কার্লড টো প্যারালাইসিস রোগ হতে দেখা যায়৷ এতে বাচ্চার পায়ের নখ বা আঙুল অবশঙ্গতার জন্য বাঁকা হয়ে যায়৷
কারণঃ ভিটামিন বি২ বা রাইবোফ্লাভিনের অভাবে এ রোগ হয়৷
লক্ষণঃ
পাখি প্রথম দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটে এবং এ সময় এর নখ বাঁকা দেখা যায়৷
গিরার উপর ভর দিয়ে হাঁটে এবং দাঁড়িয়ে থাকে৷
৮ - ১০ দিনের মধ্যেই ক্ষুধামান্দ্য, ডায়রিয়া, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস ইত্যাদি দেখা যায়৷
চিকিত্সা ও প্রতিরোধঃ ভিটামিন বি২-যুক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য, যেমন প্রাণীর যকৃত্, সবুজ কচি ঘাস, প্রাণীর কিডনি বা মাছের গুঁড়া ইত্যাদি অথবা ভিটামিন -মিনায়েল প্রিমিক্স নির্ধারিত পরিমাণে সরবরাহ করতে হবে৷
১০. ঠোকরা-ঠুকরি বা ক্যানিবালিজম (Cannibalism)
ক্যানিবালিজম আসলে কোন রোগ নয় বরং এক ধরনের বদভ্যাস৷ এটি এমনই এক ধরনের বদভ্যাস যাতে একটি কোয়েল অন্য একটি কোয়েলের পালকবিহীন বা কম পালকযুক্ত অংশে ঠোকরাতে থাকে৷ এবং রক্ত বের করে ফেলে৷ সাধারণত ব্যাটারি বা খাঁচা পদ্ধতিতেই ঠোকরা-ঠুকরি বেশি দেখা যায়৷
রণঃ ক্যানিবালিজমের বহু কারণ রয়েছে৷ যেমন-
১. ধারালো ও চোখা ঠোঁথ৷
২. খামারে গাদাগাদি অবস্থা৷
৩. আরজিনিন নামক অ্যামাইনো এসিডের অভাব৷
৪. অত্যাধিক আলো৷
৫. অত্যাধিক তাপ৷
৬. স্ট্রেস বা পীড়ন৷
৭. আহত পাখিকে সুস্থ পাখি থেকে পৃথক না করা৷
৮. বিভিন্ন বয়সের কোয়েল একই খাঁচায় বা ঘরে রাখা৷
৯. খাদ্যে আমিষ ও লবণের অভাব৷
১০. অপর্যাপ্ত খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা৷
১১. অলসতা ইত্যাদি৷
চিকিত্সা ও প্রতিরোধঃ যেসব কারণে ঠোকরা-ঠুকরি দেখা দেয় তা দূর করতে হবে৷ তবে আগে থেকেই এদিকটায় নজর দিলে ঠোকরা-ঠুকরি দেখা দেবে না৷ তাছাড়া এটি প্রতিরোধের জন্য সঠিকভাবে ঠোঁট ফাটা বা ডিবিকিং করা একটি উত্তম ব্যবস্থা৷
১১. ডিম আটকে যাওয়াঃ
ডিম পাড়ার সময় অনেক কোয়েলের ডিম ডিম্বনালীতে আটকে যায়, বাইরে বের হতে পারে না৷ যেহেতু কোয়েল প্রায় প্রতিদিনই ডিম পাড়ে তাই অধিক উত্পাদনশীল এসব কোয়েলে কখনো কখনো এমনটি ঘটতে দেখা যায়৷
কারণঃ নিম্নলিখিত কারণে ডিম আটকে যেতে পারে৷ যেমন-
ক. ডিমের আকার অনেক বড় হলে৷
খ. ডিমের খোসা খসখসে হলে৷
গ. ডিম পাড়ার সময় এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থের নিঃসরণ কম হলে বা না হলে৷
ঘ. ডিম্বাশয়ে প্রদাহ বা অন্য কোন রোগ হলে৷
ঙ. ডিমপাড়া কোয়েলের অত্যাধিক চর্বি হলে৷
চ. ডিম পাড়ার সময় কোয়েলকে বিরক্ত করলে৷
লক্ষণঃ এতে নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে৷ যেমন-
ক. কোয়েল সবসময় ছটফট করে৷
খ. ডিম পাড়ার জন্য বারবার যায় কিন্তু ডিম না পেড়ে চলে আসে৷
গ. ঘনঘন কোঁথ দেয়৷
ঘ. পায়ুপথ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে৷
ঙ. পেটে ডিম ভেঙ্গে গেলে কোয়েল মারা যায়৷
চিকিত্সাঃ
গরম পানিতে এক টুকরা কাপড় ভিজিয়ে নিয়ে কোয়েলের পায়ুপথের চারদিকটায় হালকাভাবে বুলিয়ে দিতে হবে৷ এরপর আঙুলের সাহায্যে ভেসিলিন জাতীয় পিচ্ছিল পদার্থ পায়ুপথের ভিতর দিয়ে ডিম্বনালীর চারপাশে লাগালে তা পিচ্ছিল হয়, ফলে ডিম বের হয়ে আসে৷ বিশেষ পরামর্শঃ জন্মের প্রথম সপ্তাহে প্রতি লিটার খাবার পানিতে এক গ্রাম মাত্রায় টেট্রাসাইক্লিন মিশিয়ে পান করালে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগের কবল থেকে বাচ্চা কোয়েলকে রক্ষা করা সম্ভব হয়৷
জেনে নিন কোয়েলের কিছু সাধারণ রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য:
কোয়েলের রোগ ও চিকিৎসা:-
রোগ বালাইঃ-
কোয়েলের রোগবালাই নেই বললেই
চলে। সাধারণত কোনো ভ্যাকসিন
অথবা কৃমিনাশক ঔষধ দেয়া হয় না। তবে
বাচ্চা ফুটার প্রথম ২ সপ্তাহ বেশ
সংকটপূর্ণ। এ সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে
কোয়েলের বাচ্চার যত্ন নিতে হয়।
বাচ্চা অবস্থায় অব্যবস্থাপনার কারণে
কোয়েলের বাচ্চা মারা যায়। তবে,
বয়স্