28/11/2016
বিশুদ্ধ মধু আহরন
পবিত্র কোরআন এর ‘সুরা নাহল’এ আল্লাহতায়ালাসহজ ভাবে বর্ননা করেছেনমানুষের সৃষ্টির কথা, পশু, পাখি, উদ্ভিদ, পতঙ্গ, সাগর, নদী, পাহাড়, পর্বত ও নক্ষত্রের উপকারিতা; দান করেছেন পান করার জন্য বিশুদ্ধ সুস্বাদু দুগ্ধ, খেজুর ও আঙ্গুর।আল্লাহ বলেন,“তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে উহার অন্তরে ইংগিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন ‘গৃহ নির্মান কর পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মান করে তাহাতে; ইহার পর প্রত্যেক ফল হইতে কিছু কিছু আহার কর, অত:পর তোমার প্রতিপালক তোমার জন্য যে পদ্ধতি সহজ করিয়াছেন তাহার অনুসরনকর।’ উহার উদর হইতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়; ইহাতে মানুষের জন্য আছে ব্যাধির প্রতিকার। অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রহিয়াছে নিদর্শন (সুরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৬৮-৬৯)”। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার জন্য পুষ্টি ও রোগ প্রতিকারের ঔষধের যোগান দিয়েছেন এবং তা সহজ ভাবে কোরআনে বর্ননা করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান অনেক রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধের ঔষধ এবং পদ্ধতি বের করেছে তবে কোরআনে বর্নিত সহজ পথ গুলো আগে প্রয়োগ করা দরকার।
নির্মিত মৌমাছির গৃহ
কাঠ দিয়ে মৌমাছির গৃহ নির্মান করা হয়। সাধারনত: দৈর্ঘ্য ১৯.৫ ইঞ্চি, প্রস্থ্য ১৬.৫ ইঞ্চি আর উচ্চতা ১০.৫ ইঞ্চি হয়এবং মৌমাছির চাক তৈরী করার জন্য ঢাল থাকে ৫ টি অথবা ৮টি। প্রতি ঢালে একটি পাতলা মোমের সিট লাগিয়ে দিতে হয়। রানী, পুরুষ ও শ্রমিক মৌমাছি একই চাকে থাকে। একের অধিক রানী জন্মালে সেগুলো আলাদা গৃহে দেয়া হয়।
মৌ-উদ্ভিদ
মৌমাছি যে সকল উদ্ভিদ হতে মধু সংগ্রহ করে তাকে মৌ-উদ্ভিদ বলে। সুন্দর বনে একই সাথে অনেক বৃক্ষে ও বিরুৎজাতীয় উদ্ভিদে ফুল ফোটে তা থেকে জংলি মৌমাছি প্রচুর পরিমান মধু সংগ্রহ করে চাকে জমা করে। বিশেষ শ্রেনীর শ্রমিক একই সাথে বনে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহের অনুমতি পায় এবং প্রচুর পরিমান মধু সংগ্রহ করে থাকে। গৃহ পালিত মৌমাছি দিয়ে মধু আহরন করতে হলে সেখানে প্রচুর মৌ-উদ্ভিদের ফলের বাগান/বির্স্তীন এলাকা জুড়ে মৌ-উদ্ভিদ ফসলের ক্ষেত থাকতে হবে। বাংলাদেশে কৃষি ভিত্তিক প্রধান মৌ-উদ্ভিদ হলো লিচু, সরিষা, কালোজিরা, তিল, ইত্যাদি।
মধু আহরন
স্থানীয় বাজারে লিচুর চাহিদা বাড়ায় বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাবে লিচু গাছের চাষ হচ্ছে। তাই লিচুর বাগানে যখন ফুল ফোটে তখন মৌচাষীরা অনেক মৌমাছির গৃহ গাছের নিচে বসিয়ে দেয় এবং মৌমাছি কাছের লিচু ফুল থেকে মধু এনে চাকে জমা রাখে। সাধারণত: ফাল্গুন মাসে লিচু বাগানে ফুল ফোটা শুরু করে তখন মৌ-গৃহ বসানোর ৭ থেকে ১০ দিন পর প্রথম সংগহ শুরু করে তারপর ৭ দিন পর পর মধু সংগহ করে থাকে। প্রতি বারে ৩থেকে ৫ কে.জি. মধু সংগৃহিত হয়ে থাকে। লিচু ফুলের মধু হালকা বাদামি রঙের হয়ে থাকে। চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহে লিচুর ফুল ফোটা শেষ হয়ে যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে সরিষা চাষ হওয়ায় এর ফুল থেকে মৌ-গৃহ দিয়ে প্রচুর পরিমানে মধু আহরন করা হচ্ছে। লিচু ফুলের মতো ৩-৫ কে.জি. মধু প্রতি সপ্তাহে প্রতি মৌ-গৃহ থেকে আহরন করা হয়ে থাকে। প্রতি মৌ-গৃহ হতে কী পরিমান মধু সংগৃহিত হবে তা নির্ভর করে ওই গৃহে শ্রমিক মৌমাছির উপর। সরিষার বেশ কয়েকটি জাত রয়েছে যার কারনেঅগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিক থেকে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কোন কোন জাতে ফুল ফুটতে থাকে তাই দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর মধু অহরন করা যায়। সরিষার মধু লালচে বাদামি রঙের হয়ে থাকে তবে লালচে সরিষার মধু রঙ আর সাদা সরিষার মধুর রঙ লালচে থেকে হালকা রঙের হয়ে থাকে। এ ফুলের মধু সহজেই জমাট বেঁধে যায়।সরিষার ফুল ফোটার শেষের দিকে কালো জিরা, ধনে, তিশি, পিঁয়াজ ইত্যাদি ফসলে ফুল ফোটে, সে সব ফসল থেকেও মধু সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। কালো জিরার মধু কালচে বাদামি রঙের হয়ে থাকে। কোন কোন জায়গায় ব্যাপক ভাবে তিল চাষ হয় এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফুল ফোটে সেখান থেকেও মধু সংগ্রহ করা হয় তবে ঝড় বৃষ্টির সময় হওয়ায় অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয়। তিলের ফুলের মধুও কালচে রঙ হয়ে থাকে।
পদ্ধতি
সারা বছর ধরে মৌ-গৃহের যতœ নিতে হবে। প্রতিটি গৃহে যেন একটি রানী, পুরুষ ও প্রচুর শ্রমিক মৌমাছি থাকে। প্রতিটি ঢালে যেন চাক থাকে, কোন পোকার আক্রমন না হয় বা ভেঙ্গে না যায়। খামারে মৌ-গৃহ ও মৌমাছির ভালভাবে পরিচর্যা করতে হবে।
# সরিষা, লিচু, তিল, ইত্যাদির ক্ষেত্র/বাগান যথা সময়ে ফুল ফোটার অবস্থা সরোজমিনে দেখে নির্বাচন করুন।
# প্রতিটি মৌ-গৃহ বিশেষ ধরনের পাটের চট অথবা শুক্ষ্ম জাল দিয়ে ভাল ভাবে ঢেকে মৌ-উদ্ভিদের ক্ষেতে বা বাগানের উপযুক্ত স্থানে রাখুন।
# সূর্য উঠার পর মৌ-গৃহের মুখ থেকে চট/জাল সরিয়ে দিন।
# সূর্য উঠার পর থেকে শ্রমিক মৌমাছি গৃহ থেকে বের হতে থাকবে, মধু সংগ্রহ করে গৃহে ঢুকবে, সংগৃহিত মধু চাকে রেখে আবার বের হয়ে যাবে এভাবে বিরতিহীন ভাবে মধু সংগহ করতে থাকবে। সূর্য ডোবার পূবেই মৌমাছি গৃহে ঢুকে যাবে আর অবিরাম পাখা দিয়ে চাকে বাতাস করতে থাকবে।
# চাকের একটি প্রকোষ্ঠ মধুতে পূর্ণ হলে মুখ ঢেকে দিবে এভাবে চাকের সকল প্রকোষ্ঠ ভরতে প্রায় এক সপ্তাহ বা কিছু বেশি সময় লাগবে। প্রতিটি মৌ-গৃহ ভাল করে দেখে উপযুক্ত চাক মধু ভাঙ্গার মেশিন দিয়ে মধু আহরন করতে হবে।
# ২০ কে.জি. বা৪০ কে.জি. ধারন ক্ষমতার প্লাষ্টিক কন্টেইনার ভাল ভাবে ধুয়ে, মুছে ও রোদে শুকায়ে প্রস্তুত রাখতে হবে।
# চাক বাগৃহ থেকে সংগৃহিত মধু কন্টেনারে ঢেলে পূর্ন করতে হবে। সুবিধা জনক সময়ে মাঠ থেকে এনে গুদামে রাখতে হবে।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
ক্ষেত/বাগানে মধু সংগ্রহের পর মধুর কন্টেইনার মৌ-চাষিদের খামারে নিয়ে আসে ও মাঝে মাঝে কন্টেইনারের মুখ খুলে রোদে দিয়ে থাকে। সাধারনত: মধু সংগ্রহের পর পরই মৌ-চাষিরা মধু বিক্রি করে দিয়ে থাকে। যারা মধু বাধাই করবে তারা পাস্তুরাইজেসন পদ্ধতির মতো একটি পানির পাত্রের মধ্যে আরো একটি পাত্রে মধু দিয়ে ৬৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৩০ মিনিট তাপ দিয়ে কাঁচের পাত্রে অথবা খাদ্যমানের প্লাষ্টিকের পাত্রে সংরক্ষন করবে।
সতর্কতা
মৌ-গৃহ পদ্ধতিতে সংগৃহিত মধু নষ্ট হয়েছে অথবা ফার্মান্টেড হয়েছে এ রকম কোন নজির নেই। মৌচাষিদের মধু সংগ্রহের খরচ কম তাই তাদের ভেজাল মিশ্রনোর সুযোগ কম তাছাড়া বিক্রয় বাজার হারানো ভয় থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা চিনির সিরা মিশিয়ে থাকলে তা ফার্মান্টেড হয়ে থাকে ও গন্ধ হয়ে যায়। তাই মৌচাষিদের নিকট থেকে মধু সংগ্রহ করা উত্তম।
উপসংহার
মধুর পুষ্টিগুন বিবেচনায় উন্নত দেশে এর উৎপাদন ও খাদ্য হিসাবে গ্রহন অনেক বেশী। আমাদের দেশে পুষ্টির জন্যমধু খাদ্যহিসাবে গ্রহন নগন্য তবে ঔষধ বিবেচনায় অল্প সংখ্যক লোক মধু ব্যবহার করে থাকে। স্বাস্থ্য চেতনা বৃদ্ধি করে রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য অধিক পরিমানে মধু খেতে হবে। পুষ্টিমান বিবেচনায় আমাদের সকলকেই অধিক মধু খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত ও প্রতিদিনের পুষ্টি ঘাটতি মিটানো উচিত।