07/12/2019
ক্যারিয়ার গড়তে পারেন ভেটেরিনারি পেশায়
সাজ্জাদ হোসাইন
০৮ ডিসেম্বর ২০১৯,
ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম)। ডাক্তার হওয়ার অন্যতম এক রাস্তা। যে সকল ছোট ভাই ও বোনেরা মেডিকেলে চান্স পাননি, কিন্তু সমন্বিত কৃষি পরীক্ষায় এই সাবজেক্ট পেয়েছেন তাদের তো সোনায় সোহাগা। সাধারণ মানুষ বা ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীদের মাঝে এই পেশা নিয়ে বিস্তারিত স্বচ্ছ ধারণা খুব কম মানুষের মাঝেই আছে।
হাতেগোনা সামান্য কিছু শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দের বিষয় হিসেবে এই ডিভিএম থাকে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর এই ডিভিএমই ভালোবাসার বিষয়ে পরিণত হয়। ডাক্তারি পেশা খুবই মর্যাদা সম্পন্ন মহান পেশা এবং একমাত্র এই পেশাতেই একজন মানুষ অন্যকে খুব কাছে থেকে সাহায্য করতে পারেন। তাই অনেকেরই স্বপ্ন থাকে আমি বড় হয়ে ডাক্তার হব, মানুষের সেবা করব। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হয়তো বা খুব অল্প কিছু ভুলের কারণে অনেকেই লক্ষ্যচ্যুত হয়েছেন। তাই তাদেরকে বলব আপনাদের আশা ছেড়ে দেওয়ার মতো এখনো কিছু হয়নি। ডাক্তারিকে জীবনের পেশা হিসেবে বেছে নিতে নিঃসন্দেহে ভেটেরিনারি নিয়ে পড়তে পারেন।
তাই আজ একটু ভেটেরিনারি পেশা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব :
ওয়াল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) অনুযায়ী শুধু মেডিকেল, ডেন্টাল ও ভেটেরিনারি ছাত্ররাই ডিগ্রি শেষে নামের আগে ডাক্তার শব্দটি বসানোর যোগ্যতা অর্জন করেন। তাই আপনিও নিজেকে একজন ভেট ডাক্তার হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।
ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন পাঁচ বছর মেয়াদি কোর্স। এখানে পড়ানো হয়- অ্যানাটমি, হিস্টোলজি, বায়োক্যামিস্ট্রি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি, মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি। যা কিনা পিওর মেডিক্যাল সায়েন্সের সাবজেক্ট। এগুলো ছাড়াও এখানে কৃষি/ পশু পালন/ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কিছু কিছু সাবজেক্ট যেমন অ্যাগ্রনমি, অ্যানিমাল সাইন্স, পোল্ট্রি সাইন্স ইত্যাদি পড়তে হয়। একজন ভেটেরিনারি গ্র্যাজুয়েটকে এসব কঠিন সাবজেক্ট পড়ার পাশাপাশি প্রাণিজগতের হিউম্যান স্পিসিসসহ প্রায় ১৪-১৫টি স্পিসিস সম্বন্ধে জ্ঞান রাখতে হয়। যা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ।
জেনে রাখা ভালো প্রাণিজগতের প্রায় সকল প্রাণীর অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি অনেকটা একই। আর বায়োক্যামিস্ট্রি ও মাইক্রোবায়োলজি হুবহু একই বলা চলে। তাই ডক্টর অব হিউম্যান মেডিসিন এবং ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিনকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
উচ্চতর শিক্ষায় ডিভিএম পাস করার পর নিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মেসি, মেডিসিনসহ বিভিন্ন মেডিকেল বিষয়ক অন্যান্য বিষয়ে এমএস ও পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জাপান, কোরিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় দেশসহ বিভিন্ন দেশে স্কলারশিপের সুযোগ রয়েছে। বহির্বিশ্বে স্কলারশিপের দ্রুত সুযোগ ভেটেরিনারি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে সম্ভব নয়।
চাকরির ক্ষেত্রে আপনাদের সেক্টর গুনে শেষ করা যাবে না। একজন ভেট ডক্টর যদি দেশের বাইরে যেতে চায় তাহলে খুব সহজেই বাইরে সেটেল্ড হতে পারেন। দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে যেমন- অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, কানাডা, ফিনল্যান্ড, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে সম্মানজনক চাকরির সুযোগ ভেটেরিনারি পেশার ক্ষেত্রে কতটা সহজ তা ইন্টারনেট ভিজিট করলে আপনারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন, পাবলিকেশন, বিভিন্ন অর্গানাইজেশন যেমন- ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, হু, ইউএন, ফাওতে চাকরি করতে পারবেন আপনারা। আবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও (যেমন- অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি) ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ রয়েছে।
সরকারি চাকরিতে ভেট ডাক্তারদের প্রথম পছন্দ থাকে বিসিএস। বিসিএসে রয়েছে স্পেশাল কোটা (প্রাণিসম্পদ) শুধু ভেট গ্র্যাজুয়েটদের জন্য। এছাড়া বিসিএসে ভেট গ্রাজুয়েটরা অন্যান্য ক্যাডারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। বিসিএসের টেকনিক্যাল ক্যাডারে প্রতিবছর অর্ধশতকের বেশি ভেট ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয় যারা জেলা ও উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। আর একমাত্র ডিভিএম গ্রাজুয়েট বিসিএসের সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্যাডারে আবেদন করতে পারেন।
এছাড়া বিসিএস নন ক্যাডার ও অন্যান্য সরকারি চাকরি আছে যার ভেতর চিড়িয়াখানায়, সাফারি পার্কে, সুন্দরবনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও চিকিৎসক হিসেবে চাকরির সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (যেমন- আইসিডিডিআরবি, বিএলআরআই, এলআরআই, এফআরআই ইত্যাদি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার ও বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনীতে ভেটেরিনারি পেশার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কোর। যার নাম আরভিএফসি (রিমাউন্ট ভেটেরিনারি অ্যান্ড ফার্ম কোর) এবং বছরে ২ বার এ সুযোগ পাওয়া যায় সরাসরি সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে। আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় ঔষধ কোম্পানিগুলোতে ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য নির্দিষ্ট আসন রয়েছে। বিভিন্ন লাইভস্টক প্রোডাক্ট কোম্পানি যেমন-আইসক্রিম, জুস, বাটার, ক্যান্ডি, কোলা, মিল্ক অ্যান্ড মিট ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার অপার সুযোগ।
বিভিন্ন কোম্পানি (যেমন- প্রাণ, মিল্ক ভিটা, আড়ং, আফতাব, আরডি মিল্ক, ব্রাক মিট, বেঙ্গল মিট ইত্যাদি) কোম্পানিতে বেতন ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। ৬টি বোনাসসহ গাড়ি ও বাড়ির সুবিধা। এছাড়া বিভিন্ন চর এলাকায় নানা প্রোজেক্টে কাজ করার সুযোগ রয়েছে (যেমন- সিএলপি, পিকেএসএফ, ব্রাক, শিশু নিলয় ফাউন্ডেশন ইত্যাদি)। বেতন ২৫ হাজার থেকে ৩০ টাকা। দেশের বিভিন্ন ফিড মিল, হ্যাচারিতে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির সুযোগ রয়েছে যেমন- কাজী ফার্মস লি., আফতাব গ্রুপ, প্যারাগন, নারিশ, এংকর ফিডস, নিউ হোপ গ্রুপ, আমান ফিড, আগাতা ফিড, ঢাকা হ্যাচারি, গোয়ালন্দ হ্যাচারি, এগস অ্যান্ড হেন, রাফিদ হ্যাচারি ইত্যাদিসহ কয়েকশ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে।
অনেকের মধ্যে একটা দ্বিধা থাকে যে, ভেটেরিনারি পড়ে অন্য কোনো চাকরি করা যাবে কি না। তাদের জন্য বলি চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেউ যদি ডাক্তারি পেশা নিতে ইচ্ছুক না হয় তাহলে এই গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি দিয়ে বিভিন্ন অফিস, ব্যাংকে মর্যাদাপূর্ণ চাকরি করা যাবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন, পাবলিকেশনে চাকরির সুযোগ রয়েছে। প্রথম শ্রেণির পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, পাঁচ তারা হোটেলগুলোতে মিট ইন্সপেক্টর, পাবলিক হেলথ অফিসার হিসেবে চাকরির সুযোগ রয়েছে। কোয়ারেনটাইনের নিমিত্তে আমদানি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানে অ্যানিমেল প্রোডাক্ট, ফিস প্রোডাক্ট ইত্যাদি আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে ভেটেরিনারিয়ানদের চাকরির সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও একজন রেজিস্টার্ড ভেট ডাক্তার পার্সোনাল প্র্যাক্টিস করতে পারবেন এবং পেট ডাক্তার হিসেবেও পার্সনাল চেম্বার দিতে পারবেন।
ভেটেরিনারির ছাত্র হিসেবে আরও সুবিধা হিসেবে প্রতি মাসে আপনি ২০০ টাকা করে বৃত্তি পাবেন যা অনন্য। এছাড়াও ইন্টার্নশিপের সময়ে পাবেন প্রতিমাসে ১৫ হাজার টাকা। যা ভেটেরিনারি ও মেডিকেলেই সম্ভব। পড়াশোনার শেষ বছরে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বাইরে ইন্টার্নশিপের সুযোগ রয়েছে।
এখন সময়টা আপনারই। কৃষির সমন্বিত পরীক্ষায় যাদের ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন সাবজেক্ট এসেছে তারা নিঃসন্দেহে অটো মাইগ্রেশন বন্ধ করে দিতে পারেন। পরে হয়তো দেখবেন মাইগ্রেশনে এমন এক সাবজেক্ট আসলো, যা ডিভিএমের মতো এত বিস্তর না। তাই এখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। যাতে ভবিষ্যতে পস্তাতে না হয়।